চোখ থাকিতে অন্ধ


কাক নিয়ে নানা ধরনের গল্প প্রচলিত আছে সেটি আমরা মোটামুটি সবাই জানি। তার মধ্যে একটি গল্পের বিষয়বস্তু অনেকটা এরকম যে একজন মহিলা (১ম মহিলা) একটি সন্তান প্রসব করলো যার গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল নয়। অপর একজন (২য় মহিলা) ঐ মহিলার সন্তান সম্পর্কে আরেকজন মহিলাকে (৩য় মহিলা) বর্ণনা দিলো যে ১ম মহিলার তো খুবই কালো একটি সন্তান হয়েছে। পরবর্তীতে ৩য় মহিলা ৪র্থ একজন মহিলাকে জানালো যে ১ম মহিলার একটি কাকের মতো কালো সন্তান হয়েছে। ৪র্থ মহিলা এরপর সবাইকে জানালো যে ১ম মহিলা একটি কাকের জন্ম দিয়েছে!

গল্পের মূল ভাষ্য আমরা সবাই বুঝে গেছি। শোনা কথা একজন থেকে আরেকজনের কাছে পৌঁছানোর সময় ধীরে ধীরে বিকৃত হতে থাকে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজে যেটি শুরু হয়েছে সেটি এই গল্পকেও হার মানাবে বলে মনে হচ্ছে। আমরা অপরের কাছে থেকে শুনে নয়, নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতাগুলোকে যেভাবে উপস্থাপন করছি তাতে উপরোক্ত মহিলার কাক জন্ম দেবার গল্পকেও লজ্জা পাইয়ে দেবে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক-

ইউএস-বাংলার প্লেনটি নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়েছে। মারা গেছে বাংলাদেশীসহ ৫০+ মানুষ যে তালিকায় আমার নিজের ফুপু শাশুড়ি এবং ফুপা শ্বশুরও আছেন। খুবই অবাক হয়ে দেখলাম সমাজের উচ্চশ্রেণীর কিছু অতিমাত্রার জ্ঞানী ব্যক্তিরা বিশাল বিশাল স্ট্যাটাসে বলে বেড়াচ্ছেন যে সমস্ত দোষ নেপালের এবং সেখানকার উদ্ধার বাহিনীর। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন প্রথমত বিমানবন্দর হতে প্লেনের পাইলটকে ভুল মেসেজ দেয়া হয়েছে যার কারণে প্লেনটি ফুটবল মাঠে অবতরণ করতে বাধ্য হয়েছে এবং দ্বিতীয়ত প্লেনটি নাকি জরুরী অবতরণের কথাও বিমানবন্দরকে আগেও জানিয়েছিল এবং ফুটবল মাঠে জরুরী অবতরণের পরও নাকি ১৫ মিনিট অবস্থান করছিলো! এই ১৫ মিনিট অবস্থান করার পর নাকি বিমানটি বিধ্বস্ত হয় এবং আগুন লাগে! তথ্যসূত্র হিসেবে কেউ কেউ আবার প্রতিবেশী দেশের কোন কোন চ্যানেলের উল্লেখ করেছেন (যদিও চ্যানেলের নাম বলেননি)।

এবার আসি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণে:

প্রচলিত আছে অতিরিক্ত বুদ্ধিমানরা বাস্তব সমাজে একটু বেকুব গোছের হয় যাদের দৈনন্দিন বিষয়ে পর্যাপ্ত বোধবুদ্ধি থাকে না। এই ধরনের বেকুব না হলে কেউ বলবে না যে প্লেনটি জরুরী অবতরণের পরও ১৫ মিনিট ফুটবল মাঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। যেখানে দেশের সমস্ত টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্রে এমনকি বিশ্বের বড় বড় সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলে প্রতিনিয়ত জানাচ্ছে যে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি অন্যরকম সেখানে কোন এক অখ্যাত নাম উল্লেখবিহীন চ্যানেলের বরাত দিয়ে (নাকি নিজের উর্বরমস্তিষ্ক প্রসূত?) এভাবে দুর্ঘটনাটিকে উপস্থাপন করা কি সমীচীন? লেখকদের আর দোষ দিয়ে কি করবো? শতশত মানুষ আবার নিজেদের বিচারবুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে সেটিতে লাইক / লাভ বা শেয়ার করছে!

নিজের দোষ অন্যের উপরে চাপানো আমাদের একটি স্বভাব হয়ে গেছে। হতে পারে নেপাল বিমানবন্দরে প্লেনটিকে বিভ্রান্তিমূলক বার্তা দেয়া হয়েছে (নিশ্চিত করে বলা যাবে না কারণ এখনও ব্ল্যাকবক্স এর তথ্য আমরা জানি না)। কিন্তু তাই বলে আমাদের সামনে নিশ্চিতভাবে যে তথ্যগুলো মিডিয়াতে আসছে সেগুলো নিয়ে আমরা কতটুকু চিন্তিত? বলা হচ্ছে এই একই প্লেনটি এর আগেও সৈয়দপুর বিমানবন্দরে মুখ থুবরে পড়েছিলো এবং তখন কর্তৃপক্ষ নামমাত্র একটি বিবৃতি দিয়ে কাজ সেরেছিল। এরপর কিছুদিন আগেও চট্টগ্রামে ইউএস-বাংলার একটি বিমান অবতরণ করার আগমূহুর্তে ল্যান্ডিং গিয়ারের সমস্যা দেখা দেয় এবং সকলের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই প্লেনটি অবতরণ করে। তাছাড়া নেপালে দুর্ঘটনার দিনই সকালে দু দু’বার ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করেছে বিমানের পাইলট এবং ক্রুরা এবং তারপর গিয়েছে নেপালে যেখানে আমার জানা মতে প্রতিটি এয়ারলাইন্সই তাদের দিনের শুরুর ‘ফ্রেস ফ্লাইটটি’ পরিচালনা করে থাকে।

এছাড়াও আরও বেশ কিছু বিষয় আছে, যেমন বিমান পরিচালনা করার সময় একটি বেসিক নিয়ম হল পাইলট যখন বিমান চালাবেন তখন সহকারী পাইলট (ফার্স্ট অফিসার) বিমানবন্দরের সাথে যোগাযোগ করবেন যাতে করে মূল পাইলটের বিমান উড়ানোর কোন প্রকার মনোযোগ বিঘ্নিত না হয়। বিশেষ করে ত্রিভুবনের মতো বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে এটি ফরজের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু ইউএস-বাংলার বিমানটি যদি ক্যাপ্টেন আবিদ চালাচ্ছিলেন তাহলে তিনিই কেন বারবার কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ করছিলেন? এর ব্যাখ্যা দু’রকম হতে পারে- (১) তিনি নিজেই বিমান পরিচালনা করছিলেন এবং যোগাযোগও বজায় রাখছিলেন (তাহলে সহকারী পাইলট কি করছিলেন? দায়িত্ব কি শুধু বসে থাকা?) অথবা (২) বিমানটি সহকারী পাইলট পৃথুলা পরিচালনা করছিলেন এবং ক্যাপ্টেন আবিদ যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন (যেটি ত্রিভুবনের মতো জায়গায় খুবই ঝুঁকিপূর্ণ!)। নেপালের ত্রিভুবনে বিমান পরিচালনা করার জন্য পাইলটদের বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ থাকতে হয়- এটাই নিয়ম। ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ বারবার বলে আসছিলেন ক্যাপ্টেন আবিদ খুবই দক্ষ যা খুবই সত্যি কিন্তু তারা সহকারী পাইলট পৃথুলার অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ নিয়ে কোন কথা বলছেন না। তাদের উচিত ছিল পৃথুলাকেও সমানভাবে সাপোর্ট দেয়া, কারণ অনেকেই এই দুর্ঘটনার জন্য পৃথুলার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

এছাড়া কোথাও মন্তব্য করার সময়ও যুক্তিতর্ক বিবেচনা করে মন্তব্য করা উচিত। বিমান দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে আমার এক আত্মীয়কে তার কোন একজন বন্ধু বলছেন ‘হয়ত ঐ বিমানে উড়ার আগে কেও আল্লাহর নাম নেয়নি তাই এরকম তো হবেই’! আরে আহাম্মক এই কথা বলে আপনি কাকে ছোট করলেন? সমগ্র বিশ্বে প্রতি বছর কোটি কোটি বিমান পরিচালনা করা হচ্ছে যাদের কোন যাত্রীই মুসলমান না তারা সবাই কি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে? বেশি ধর্মভীরু হয়ে এমন কথা বলা কি ঠিক যেটি নিজের ধর্ম এবং সৃষ্টিকর্তার সংকীর্ণতার মিথ্যা বহিঃপ্রকাশ ঘটায়! তারপরও তার যুক্তির বিপরীতে বলছি ঐ বিমানের অন্য যাত্রীদের কথা জানি না তবে আমার ফুপু শাশুড়ি এবং ফুপা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ ধর্মের সকল কিছুই করতেন- এরপর কি বলবেন? গোঁড়ামি ছাড়ুন এবং সর্ববিষয়ে ধর্মকে টেনে সামনে নিয়ে আসা বন্ধ করুন...  

অন্যের সমালোচনা করার আগে নিজস্ব বিচার-বিবেচনা কাজে লাগানো উচিত। আমাদের উচিত নিজেদের সিস্টেমকে আগে ঠিক করা। আমাদের দেশের প্লেন ক্রাশ করেছে সেজন্য দুঃখ সবাই পেয়েছে। তাই বলে গাঁজাখুড়ি তথ্যকে বিশ্বাস করা, উপস্থাপন করা এবং এসকল তথ্যে লাইক বা শেয়ার করা কি আমাদের উচিত? আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফেসবুকে ঢুঁ মেরে অন্য কারো প্রোফাইলে গিয়ে তার ওয়াল থেকে কোন একটি খবর পড়ি কিন্তু সেই একই ইন্টারনেট ব্যবহার করে যে মূল পত্রপত্রিকার লেখা পড়ে বিষয়টি সম্পর্কে সরাসরি নিজের জ্ঞানলাভ করা সম্ভব তা চিন্তা করি না। আমরা চিন্তা করি না যে প্রতিটি মানুষের নিজ নিজ পর্যবেক্ষণ এবং মতামত থাকতে পারে। আমরা আশেপাশের কোন একজন তথাকথিত প্রভাবশালী বা জ্ঞানী ব্যক্তির গুণমুগ্ধ ভক্ত সাজার চেষ্টা করে নিজের জ্ঞানগরিমা বৃদ্ধি এবং তার বহিঃপ্রকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করি...  আসুন নিজেদের চোখ কান খোলা রাখি, অন্যের উপর নির্ভরতা কমাই। আমাদের সবারই মনে রাখা উচিত গুরুর শিষ্য এমন হওয়া উচিত যাতে করে সে জ্ঞানগরিমায় ঐ গুরুকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং সেখানেই একজন প্রকৃত গুরুর প্রকৃত সার্থকতা...

No comments:

Post a Comment