লন্ডন শহরের একটি বইয়ের দোকান |
‘বই হোক নিত্য সঙ্গী’- বাক্যটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। যুক্তরাজ্যে আসার পর থেকেই ভাললাগার অনেকগুলি বিষয়ের মধ্যে একটি হল এখানকার মানুষজনের বই পড়ার অভ্যেস। রাস্তাঘাটে যাতায়াতের সময় বাসে বা ট্রেনে সারাক্ষণই দেখছি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যাত্রী খুবই মনোযোগ সহকারে বই পড়ছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে অতীব বৃদ্ধ- কেউই বাদ নেই এই তালিকায়! শুধু যে হার্ডকপি বই তা নয়- অনেকে ট্যাব বা কিণ্ডেলেও বই পড়ছে। অনেকসময়ই যাত্রাপথে আশেপাশের কাউকে বই পড়তে দেখলে লক্ষ্য করার চেষ্টা করেছি যে তারা কি বিষয়ের বই পড়ছে- বিভিন্ন ধরনের, তবে উপন্যাস জাতীয় বা গল্পের বইয়ের থেকে অন্যান্য বইয়ের সংখ্যাই বেশী মনে হয়েছে।
ছোটবেলার একটি ঘটনা খুব মনে আছে- তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, সেদিন দুপুরেই ক্লাসের বই বাদ দিয়ে গল্পের বই পড়া নিয়ে বাসায় ব্যাপক ঝাড়ি খেলাম এবং কোন রকম এই বলে বাঁচলাম যে আপাতত পরীক্ষার আগে পর্যন্ত আর গল্পের বই ছুঁয়ে দেখব না! কিছুক্ষণ পরই শুরু হলো সমস্যা... সেদিন সকালেই সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দার ভলিউম-১ কিনে এনেছি, অনেক দিন থেকেই বইটি খুঁজছিলাম, না পড়ে বসে থাকা এককথায় অসম্ভব! এরপরের ঘটনাটি একদমই সরল- আমি ক্লাসের বইয়ের মাঝে গল্পের বই নিয়ে পড়া শুরু করলাম এবং যথারীতি একটু পরে ধরা খেয়ে গেলাম, অতঃপর আমার সাধের গল্পের বইয়ের ভলিউমটি মুহূর্তের মধ্যেই বাস্তবেও কয়েক খণ্ডে খণ্ডিত হয়ে গেল! টেপদিয়ে জোড়া লাগানো বইটি এখনও বাসায় আছে!
কালের পরিক্রমায় বই পড়ার পরিধিতে নতুন নতুন বিষয় সংযোজিত হয়েছে কিন্তু ব্যাতিক্রম হল কোন বিষয় বাদ পড়েনি। যেমন এখনও ছোটদের জন্য লেখা বই বা কমিকস পড়তে ঠিক একই রকম ভাল লাগে যেমনটি লাগতো ছোটবেলায়! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বহুসংখ্যক একাডেমিক বইয়ের মালিক হয়েছি, সাথে নন-একাডেমিক বই তো আছেই। আমার বাড়িতে ছোটখাট একটি লাইব্রেরী হয়ে গেছে! বিয়ের পর আমার দৈনন্দিন জীবনে বই/লেখক নিয়ে আলোচনা বলতে গেলে একটি নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে! আমার বউ এদিক থেকে আমার চেয়ে একডিগ্রী উপরে!
অনেকর মধ্যেও দু’জন পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কথা না উল্লেখ করলে এই লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে- আমার সুপারভাইজার মহসিন স্যার (প্রফেসর, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার (অবসরপ্রাপ্ত) গফুর স্যার- তাদের দেখেছি এবং তাদের কাছে থেকে শিখেছি উপহার হিসেবে বই কতটা ভাল এবং আশেপাশের মানুষগুলোকে কিভাবে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করা যায়- যা আমরা খুব কম সংখ্যাক মানুষই করে থাকি।
একটি ভাল এবং একটি আক্ষেপের বিষয় উল্লেখ করি! ভাল বিষয়টি হল দেশের বাইরে পিএইচডি করতে আসার পূর্বে আমার ধারনা ছিল এটি দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার (আশেপাশের বিদেশফেরত মানুষজনের কথা শুনে আমার এ ধারনা জন্ম নিয়েছিল)। এই কারনে এসকল মানুষজনের অধিকাংশই বলে থাকেন ‘প্রথমে মাস্টার্স অতঃপর পিএইচডি’। আমার ধারনা এই প্রথমে মাস্টার্সের ব্যাপারটি হল বইপত্রের (+পেপার) সাথে পরিচিতি- যাতে করে পিএইচডি সহজ হয়ে যায়। আমি ছাত্র হিসেবে গবেট থাকলেও অল্পবিস্তর বইপত্রের সাথে যোগাযোগ ছিল যার কারনে হয়ত উন্নত বিশ্বে পিএইচডি করতে এসেও এই ‘পরিচিতি’ বিষয়টি মোটেও আমার জীবনকে কষ্টকর করে তোলেনি! শুধু একাডেমিক বিষয় নয়... নন-একাডেমিক বইপত্র/বিষয় নিয়েও যখন আমাদের গ্রুপের সদস্যদের (বিভিন্ন দেশের: ইংল্যাণ্ড, নেদারল্যাণ্ড, জার্মানী, স্পেন, ব্রাজিল ও চীন) বা সুপারভাইসরের সাথে আলোচনা হয় তখন তাদের অন্ততঃ এটা মনে হয়না যে আমি আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অজ্ঞাত! আর আক্ষেপের বিষয়টি হলো বর্তমান প্রজন্ম এই বই পড়ার অভ্যেসটি হতে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে! আমি জানি যে এদের মধ্যে অল্প কিছু সংখ্যাক মানুষ এখনও বই পড়ে- হয়ত এরাই প্রকাশনী বা লাইব্রেরীগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে! যদিও বর্তমানে আমার শহরের বইয়ের দোকানগুলোর মূল ব্যবসা হয়ে গেছে গাইড বা নোটবই বিক্রি!
সবশেষে একটি ফটোকপির দোকানের মালিকের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করি... এই মানুষটিকে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গত ১৫ বছর যাবত ব্যবসা করতে দেখছি। তিনি আমাকে গত বছর একটি কথা বলছিলেন- "ভাই আপনারা যে সময় ছাত্র ছিলেন তখন মূল ব্যাবসা করতাম বই ফটোকপি করে আর এখন করি নোট ফটোকপি করে...”। আফসোস... বর্তমান প্রজন্মের প্রায় প্রতিটি মানুষই স্মার্টফোন বা ল্যাপটপে ইন্টারনেট ব্যবহার করে, যাতে করে বই পড়ার ব্যাপারটি ব্যাপকভাবে প্রসারিত হবার কথা ছিলো- কিন্তু সেটি হয়নি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ফ্রি ওয়াই-ফাই আছে, ফেসবুক একাউন্ট নেই এমন ছাত্রছাত্রী খুঁজে পাওয়া দুস্কর... কিন্তু ভয়াবহ তথ্যটি হলো এই ইন্টারনেটের প্রায় ৮০-৯০% ব্যবহৃত হয় “উল্লেখ অনুপোযোগী” বিষয়বস্তু দেখার/ডাউনলোড করার কাজে...
No comments:
Post a Comment