বিদেশে উচ্চশিক্ষা: পর্ব ২

আগের পর্বে দেশের বাইরে স্কলারশীপের কিছু বেসিক তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। এই পর্বে মূলতঃ স্কলারশীপের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করছি। যদিও অনেক আগেই এই লেখাটি পোষ্ট করা উচিত ছিল কিন্তু ব্যস্ততার কারনে এই বিলম্ব...

প্রফেসর ম্যানেজ ও গবেষণার বিষয়... খুবই গুরুত্বপূর্ণ
দেশের বাইরে স্কলারশীপের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ হল একজন সম্ভবনাময় গবেষণা সুপারভাইজার খুঁজে বের করা এবং তাকে ই-মেইলের মাধ্যমে আপনি যে তার তত্ত্বাবধানে কাজ করতে আগ্রহী সেটি জানানো। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে আপনার ইমেইল পেলেই যে তিনি রিপ্লাই দিবে এমনটি নয়। প্রফেসর (সামগ্রিক অর্থে ব্যাবহৃত, যেকোন শিক্ষক/সুপারভাইজার) ম্যানেজ করা খুবই ধৈর্যের বিষয় এটি আপনাকে মাথায় রাখতে হবে। তবে সঠিক উপায়ে এবং সেই সাথে একটু ভাগ্যের সহায়তা থাকলে অল্প সময়ের মধ্যেই প্রফেসর ম্যানেজ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে একটি খুবই উপযোগী এবং সহজ পদ্ধতি হল যেসব ব্যাক্তি ইতোপূর্বে দেশের বাইরে ডিগ্রী করেছেন বা বর্তমানে করছেন তাদের সাথে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন যদি তারা আপনার হয়ে তাদের সুপারভাইজার বা অন্য কোন সুপারভাইজারকে ম্যানেজ করতে পারেন কিনা! তবে এক্ষেত্রে দেখা যায় গবেষণার বিষয় ঐ প্রফেসরের পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী হয় যা অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে, পর্যাপ্ত পূর্ব অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান নাও থাকতে পারে এবং সর্বপরি কোন দেশ পছন্দ নাও হতে পারে। কিন্তু এত সহজে কিছু পেলে তার বিনিময়ে কিছু ছাড় দেয়া যেতেই পারে!


কিন্তু কেউ যদি নিজের আগ্রহের বিষয়ের উপর গবেষণা করতে চান তাহলে তার প্রথম কাজই হলো একই বিষয়ে কাজ/গবেষণা করেন এমন প্রফেসর ম্যানেজ করা। নিজ আগ্রহের বিষয়ে কাজ করলে গবেষণা করা অনেক সহজ হয়ে যায় কারন এই বিষয়ে পর্যান্ত বেসিক জ্ঞান এবং ক্ষেত্রবিশেষে পূর্ব গবেষণার অভিজ্ঞতা খুবই কাজে দেয়। যাহোক প্রথম প্রশ্নটি হল প্রফেসর খুঁজে পাব কিভাবে? সহজ উত্তর হল ‘অনেকভাবে’। এই ‘অনেকভাবে’-কে আরও সহজ করার জন্য প্রথমে ঠিক করুন আপনি কোন দেশে কাজ করার প্রতি আগ্রহী। সেটি নির্ধারিত করে ফেলার পর গুগলে সার্চ দিতে পারে ঐ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং তাদের মান সম্পর্কে জানার জন্য– যা আপনাকে সাহায্য করবে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে বের করতে। সার্চের সময় বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে, উদহারণস্বরূপ কেউ যদি নিউজিল্যাণ্ড-এ উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হন তাহলে ‘ranking of universities in New Zealand’ লিখে সার্চ দিলেই দেখা যাবে সার্চ রেজাল্টে নিউজিল্যাণ্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামসহ র‍্যাংকিং-ও চলে এসেছে। যদিও আলাদা আলাদা র‍্যাংকিং এক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান আলাদা আলাদা হতে পারে কিন্তু সামগ্রিক ধারণা পাবার জন্য এটি একটি উপায় হতে পারে। এরপর আপনার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে যেয়ে সেখান থেকে আপনার বিষয় (সাবজেক্ট) সংশ্লিষ্ট বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট) পেজে যেতে হবে। তবে প্রথমেই উচিত সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি যোগ্যতা জেনে নেওয়া এবং সে অনুযায়ী পরবর্তী কাজ করা। ভর্তির যোগ্যতা না থাকলে সেখানে প্রফেসর খুঁজে কোন লাভ নেই। যাহোক, বিভাগের পেজ থেকে সেখানকার ফ্যাকাল্টিদের লিস্ট হতে একজন একজন করে দেখতে হবে তাদের গবেষণার বিষয় আপনার সাথে মিলে কিনা। পছন্দমত কাওকে পেলে তার কাছে ইমেইল দেয়া যেতে পারে। তবে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে একাধিক প্রফেসর পেলে সবার তথ্য টুকে রাখুন এবং একজন একজন করে ইমেইল দিন। একসাথে একই বিভাগের দু’জন বা ততোধিক প্রফেসরকে ইমেইল না দেয়াই উত্তম। ইমেইল পাঠানো পর কেউ যদি নেগেটিভ রিপ্লাই দেয় বা উপযুক্ত সময়ের মধ্যে উত্তর না দেয় তাহলে অপর জনকে ইমেইল পাঠানো উচিত। আরও একটি কথা সেটি হল শুধমাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের উপর নির্ভর করে বসে থাকা উচিত না, একই সাথে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা করা উচিত।

ইমেইলের ভাষা
খুবই সংক্ষিপ্ত কিন্তু তথ্যবহুল। গাদা গাদা বর্ণানামূলক কথাবার্তা না লিখে কাজের কথা সংক্ষেপে লিখলেই আপনি আপনার আরেকটি যোগ্যতার বহিঃপ্রকাশ প্রফেসরের কাছে তুলে ধরতে পারবেন! এধরনের ইমেইলের ক্ষেত্রে:
  • প্রফেসরকে ‘ডিয়ার স্যার’ না বলে ‘ডিয়ার প্রফেসর ড. ??? (সম্পূর্ণ নাম)’ বলে সম্বোধন করা উচিত। কারণ আমাদের মত উন্নত দেশের প্রফেসররা স্যার স্যার স্যার ডাক শুনে অভ্যস্ত নন। কেউ যদি আরও ফরমাল ভাষায় ইমেইল লিখতে চান তাহলে ‘ডিয়ার প্রফেসর ??? (ফ্যামিলি/লাস্ট নাম)’ লিখে শুরু করতে পারেন।
  • ইমেইলটিকে ছোট ছোট দু/তিনটি প্যারায় বিভক্ত করুন। সম্বোধনের পর প্রথম প্যারার প্রথমেই তাকে অভিনন্দন জানান একটি বা দুটি শব্দে! এরপর নিজের পরিচয় দিন– শিক্ষকতা বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে জড়িত থাকলে সেটি প্রথমে উল্লেখ করুন। এরপর আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা তুলে ধরুন। এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার কোন কিছু উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। শুধু ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স এর কথা বলুন।
  • দ্বিতীয় প্যারাতে প্রফেসরের কাজের কোন বিষয়টি দেখে আপনি তাঁর প্রতি আগ্রহী হয়েছেন তা জানান এবং সেই বিষয়ের সাথে আপনার পড়াশুনা বা গবেষণা অভিজ্ঞতার কি মিল আছে সেটি তুলে ধরুন (হতে পারে সেটি আপনার কোন থিসিসের বিষয়বস্তু সাথে মিল আছে বা আপনার কোন জার্নাল আর্টিক্যাল এর সাথে)। এরপরের বাক্যে আপনার গবেষনা অভিজ্ঞতা (কত বছরের/মাসের) ও পাবলিকেশনের (সংখ্যা) কথা বলুন।
  • তৃতীয় প্যারাতে লিখুন যে আপনি আপনার একটি সিভি তাঁর বিবেচনার জন্য এই ইমেইলে যোগ করছেন এবং আপনি খুবই কৃতজ্ঞ থাকবেন তার প্রতি যদি তিনি এটি একবার দেখেন। এরপর সর্বশেষের লাইনে লিখুন যে আপনি তার জবাবের প্রত্যাশায় থাকবেন। ইমেইলের একদম শেষে আপনার পূর্ণ নাম, বর্তমান অবস্থার (চাকুরীর বা ছাত্রাবস্থা) পূর্ণ তথ্য যোগ করুন।
ইমেইলের ভাষা নির্ভুল হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছুদিন আগে লক্ষ্য করলাম ফেসবুকে আমার বিভাগের কিছু ছাত্রছাত্রী কোনও একজনের একটি নমুনা ইমেইল শেয়ার করেছে যেখানে ইংরেজীর যে বহর তাতে কোন ইংলিশ-স্পিকিং দেশের প্রফেসর রিপ্লাই দিলে আমার থেকে বেশী কেউ অবাক হবে না। যাদের নিজের ইংরেজীর জ্ঞানের প্রতি অনাস্থা আছে তারা অবশ্যই ভাল ইংরেজী জানেন এমন কাওকে দিয়ে ইমেইলটির ভাষা দেখিয়ে নিবেন।

উপরের এই নমুনাটি শুধুমাত্রই একটি নমুনা! ব্যাপারটি এমন নয় যে এর ব্যাতিক্রম ইমেইল লিখলে তার জবাব পাওয়া যাবে না। কারন আমরা সবাই জানি ব্যক্তিভেদে ইমেইলের ভাষা বিভিন্ন রকম হতে পারে।

স্কলারশীপের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়?
একজন আবেদনকারীকে স্কলারশীপের পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে পূর্ব হতেই খুবই স্বচ্ছ ধারনা থাকতে হবে। এর জন্য প্রথমেই স্কলারশীপের বিজ্ঞাপনটি ভালমত পড়তে হবে এবং সেখানে আবেদনের প্রক্রিয়া, যোগ্যতা এবং কোন কোন বিষয়গুলি স্কলারশীপের বিবেচনার জন্য বিবেচনা করা হবে তা জানতে হবে। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত বেশীরভাগ স্কলারশীপেই নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
  • একাডেমিক ব্যকগ্রাউণ্ড: অর্থাৎ আপনার কোন কোন ডিগ্রী আছে এবং রেজাল্ট কেমন। এক্ষেত্রে এসএসসি বা এইচএসসি ডিগ্রীসমূহ উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই।
  • রেকমেনডেশন লেটার: এমন ব্যক্তির কাছে থেকে এটি নিতে হবে যিনি আপনার শিক্ষা/গবেষণা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত এবং আপনার সম্পর্কে সর্বোচ্চ ভাল লিখবেন। এক্ষেত্রে গবেষণা সুপারভাইজার বা সরাসরি শিক্ষক হলে সবচেয়ে ভাল। অনেকেই বলে থাকেন যে রেফারেন্স সবসময় সিনিয়র কারো কাছে থেনে নেয়া উচিত কিন্তু ব্যাপারটি সেরকম নয়। জুনিয়র কারো (যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক/লেকচারার) কাছ থেকে রেকমেনডেশন লেটার নিয়েও খুবই ভাল স্কলারশীপ পেতে আমি নিজে দেখেছি। আসল ব্যাপারটি হল যিনি এই পত্রটি দিবেন তিনি কি লিখবেন এবং তার সাথে আবেদনকারীর একাডেমিক/গবেষণার সম্পর্ক কি ধরনের তার উপর।
  • গবেষণা অভিজ্ঞতা ও পাবলিকেশন: অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যেটি স্কলারশীপের ক্ষেত্রে। আবেদনকারীর পাবলিকেশনের (জার্নাল আর্টিক্যাল) মান এবং সংখ্যা, তার মাস্টার্স থিসিসের বিষয়, কোন গবেষণা প্রকল্পে চাকুরীর অভিজ্ঞতা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে স্কলারশীপ পাওয়ার বিষয়টি। অনেকেই বলে থাকেন ইন্টারন্যাশনাল পাবলিকেশন ব্যাতীত স্কলারশীপ পাওয়া যায় না কিন্তু কথাটি সম্পূর্ণ ভুল। আসল ব্যাপারটি হল আপনার পাবলিকেশনের মান কেমন। ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ধারী বা ওয়েব অব সায়েন্স/স্কুপাস ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত জার্নাল হলে খুবই ভাল কিন্তু না হলে যে স্কলারশীপ পাওয়া যাবে না কথাটি সত্য নয়। একটি ব্যাপার ভাল মত মনে রাখা প্রয়োজন যে আপনার আর্টিক্যালের ভাষা, ব্যবহৃত পদ্ধতি (মেথডোলজী), এনালাইসিস খুবই ভাল হতে হবে এবং যে জার্নালে পাবলিকেশন করবেন সেটি পিয়ার-রিভিউড হতে হবে। আজকাল অনেক জার্নালই (বাংলাদেশ ভারতসহ আমেরিকার মত দেশের অনেক জার্নালই) টাকার বিনিময়ে কোন রকম মান-সম্মত রিভিউ ছাড়াই আর্টিক্যাল প্রকাশ করে ফেলে, এবিষয়গুলো হতে দূরে থাকতে হবে। চেষ্টা করতে হবে ভাল কোন জার্নালে আর্টিক্যাল প্রকাশ করার এবং এজন্য ঐধরনের জার্নালের আর্টিক্যালগুলি ভালমত পড়তে হবে এবং সেই মান অনুযায়ী নিজের গবেষণার পেপারটি প্রস্তুত করতে হবে।
  • ইংরেজীর দক্ষতা: ভাল স্কলারশীপ পেতে হলে অবশ্যই ইংরেজীতে আপনার দক্ষতা থাকতে হবে। তবে এশিয়ার দেশসমূহে ইংরেজী টেস্টের (আইইএলটিস/টোফেল বা অন্যান্য) স্কোর ব্যাতীতও স্কলারশীপ পাওয়া যায়।
কিছু কথা...
যাদের দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার ইচ্ছে আছে তারা অবশ্যই তাদের সকল একাডেমিক (সার্টিফিকেট/মার্কসশীট বা ট্রান্সক্রিপ্টস) বা ব্যক্তিগত কাগজপত্র (বার্থ সার্টিফিকেট, ম্যারেজ সার্টিফিকেট ইত্যাদি) ইংরেজীতে তৈরী রাখবেন। ড্রাইভিং শিখে রাখতে পারেন এবং সেই সাথে একটি ‘আসল’ ড্রাইভিং লাইসেন্স করে রাখবেন। অনেক গবেষণার ক্ষেত্রে আপনাকে ড্রাইভ করেই ফিল্ডে যেতে হবে (যেমন আমার নিজের ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটেছে)- সুতরাং অন্যের উপর থেকে নির্ভরশীলতা যত কমানো যায় ততই ভাল...

No comments:

Post a Comment