চিরস্বাধীন রাজ্যে (ত্রিপুরা) কয়েকদিন

উজ্জয়ন্ত প্যালেস, আগরতলা
এই সেই আগরতলা! অবশেষে স্বশরীরে এই শহরে! ৮ এপ্রিল ২০১৬ তারিখ দুপুরে আখাউড়া বর্ডার পার করে ভারতের ত্রিপুরার রাজ্যের রাজধানী আগরতলা শহরে প্রবেশের সাথে সাথে এই কথাটিই বার বার মনে হচ্ছিল! যে আগরতলার কথা ছোটবেলা থেকে এতবার শুনেছি (বিশেষ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারনে...) যে ভারতে ভ্রমনের কথা মনে হলে প্রথমেই উত্তর-পূর্ব ভারতের কথা মনে পড়ে যেত। অবশ্যই আমার প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর ‘প্রথম আলো’-এর একটি বিশাল ভূমিকা আছে ত্রিপুরা দেখার আগ্রহ তৈরীর পিছনে। কয়েকদিন আগেই ফেব্রুয়ারী মাসে দার্জেলিং এ একটি কনফারেন্সে যাবার সুযোগ ইচ্ছে করেই নষ্ট করলাম। তবে আখতার স্যার যখন জানতে চাইলেন ত্রিপুরা যাব কিনা তখন আর সুযোগ নষ্ট করলাম না। ভারতের অন্য অংশে যাবার সুযোগ মাঝে মধ্যেই পাওয়া যাবে কিন্তু উত্তর-পূর্ব অংশে যাবার এরকম সুযোগ হেলায় হারানোর কোন মানেই হয় না! আগের রাতে রাজশাহী হতে ধূমকেতু ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে ভোরে ঢাকায় পৌঁছে প্রায় ১ ঘন্টা পরে পারাবতে আখাউড়ার স্থলবন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা। ইমিগ্রেশন পার করতে তেমন কোন ঝামেলা হল না, তবে দু’পাড়ে যেন আকাশ পাতাল তফাত। বাংলাদেশের অংশ খুবই জরাজীর্ণ হলেও ভারতের অংশ ঠিক বিপরীত! একই ধরনের বিপরীত মন্তব্য প্রযোজ্য কর্মকতাদের কর্তব্যের গতির ক্ষেত্রেও!
আমাদের জন্য অপরপাড়ে অপেক্ষা করছিলেন ত্রিপুরা গ্রাজুয়েট ফিশারীজ অফিসার্স এসোসিয়েশনের ব্যক্তিবর্গ- যাদের আমন্ত্রনেই আমাদের এই আগমন। আখাউড়া বর্ডার পার হয়ে ওপাড়েই আগরতলা শহর। আপাতত আমাদের গন্তব্য শহীদ ভগৎ সিং যুব আবাস- সেখানেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। গাড়িতে যেতে যেতে রাস্তার দুপাশের দৃশ্যই মনে করিয়ে দিচ্ছিল এই ঐতিহাসিক শহরের ইতিহাস। শহরের রাস্তাঘাট বেশ প্রশস্ত এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। বাড়িঘরের মধ্যেও একটি ঐতিহাসিক চিহ্ন আছে, কেমন যেন রাজ-রাজাদের আমলের ছাপ স্পষ্ট। পথেই যেতে যেতে জেনে নিলাম শহরের দোকানপাট কতক্ষণ খোলা থাকে, রাতের বেলা বের হলে নিরাপত্তা জনিত কোন সমস্যা আছে কিনা... জানলাম আগরতলায় রাতের বেলায় নিরাপত্তাজনিত কোন সমস্যা নেই...

আগতলার শহরতলী
বিকেলে গেলাম সেন্ট্রাল এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি এর কলেজ অব ফিশারীজ-এ, যেটি আগরতলা শহরের পাশেই লেম্বুছেড়ায় অবস্থিত। কলেজটির অবস্থান, পরিবেশ ও ক্যাম্পাসের আকার দেখে খুবই বিমোহিত হলাম। পাহাড়ী উঁচু-নিচু পরিবেশে অবস্থিত কলেজটি শিক্ষার জন্য নিঃসন্দেহে খুবই উপযোগী। সন্ধ্যার পর বের হলাম মোবাইল সিম কেনার জন্য। কিন্তু আশেপাশের কোনও দোকানেই সিম পাচ্ছিলাম না। কিছুদূর হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে ১৫-১৬ বছর বয়সী একটি ছেলেকে (যদিও পরে খেয়া [আমার লাইফ পার্টনার!] জানিয়েছিল যে সেই ছেলেটি ছিল আসলে একটি মেয়ে!!!) সামনে পেয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম আশেপাশে মোবাইল সিম কোথায় পাব? সে গড়গড় করে পরামর্শ দিল যেহেতু রাত হয়ে গেছে তাই আশাপাশে কোথাও না খুঁজে সোজা ‘কামাল চৌমুহনী’ (আগরতলা শহরের কেন্দ্র) চলে যেতে... ভারতীয় ছেলেমেয়েরা যে ইংরেজীতে খুব ভাল হয় সেদিন আরেকবার বুঝলাম। সাবলীল ইংরেজী এবং সেই সাথে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ- দুটোতেই এই অপেক্ষাকৃত বয়সে ছোট মানুষটিও তার যোগ্যতার প্রমাণ দিল। আমি কখনই বাংলার বিপক্ষে নই কিংবা ছোট করি না বরং অনুধাবণ করি বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্রে ইংরেজীর প্রয়োজনীয়তা।

ফিশারীজ কলেজের সামনে...
অবশেষে সিম পেলাম একটি দোকানে যার মালিকের জন্ম বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এপাড়ে চলে এসেছেন, এখনও আত্মীয়-স্বজন বাংলাদেশে আছেন। ভদ্রলোক সেদিন শৈববের স্মৃতি এবং আত্মীয়-স্বজনদের কথা বলতে বলতে চেহারার বিষন্নতা ঢাকতে পারেননি! পরবর্তীতে যা দেখলাম আগরতলা শহরে যাদের বয়স মোটামুটি ৫০ এর আশেপাশে প্রায় সবাই জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে! প্রায় সবারই আত্মীয় স্বজনেরা এখনও বাংলাদেশে বাস করে বিশেষ করে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। সিম কেনার পর পাশের একটি ঔষধের দোকান থেকে টাকা ভাঙ্গিয়ে রূপী করে নিয়ে ফিরে এলাম শহীদ ভগৎ সিং যুব আবাসে। পরদিন দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের প্রথম দিন। রাজ্যের মাননীয় মূখ্যমন্ত্রী শ্রী মানিক সরকার প্রধান অতিথি ছিলেন। অনেক শুনেছিলাম এই বর্ষীয়ান নেতার কথা, আজ স্বচক্ষে দেখলাম। কিছু কিছু মানুষ থাকে যখন তারা কথা বলেন অন্যরা তখন হা করে তা শোনেন... ইনিও এই ধরনের একজন মানুষ যার বক্তৃতা আমিও হা করে গিলছিলাম!

ভিআইপি ব্যাক্তিদের মাঝে আমি চুনোপুঁটি (মূখ্যমন্ত্রীর পাশে!)
বিকেলে বের হলাম আগরতলা ঘুরে দেখতে, প্রথমেই গেলাম উজ্জয়ন্ত প্যালেস (বর্তমানে ত্রিপুরা স্টেট মিউজিয়াম উজ্জয়ন্ত প্যালেস  নামে পরিচিত)। বিধি বাম... শনিবার সরকারী ছুটির দিন থাকায় সেটি বন্ধ। সুতরাং গেটেই বাইরে থেকে উঁকিঝুকি মেরেই সন্তুষ্ট থাকতে হল। আগরতলা শহর হতে প্রায় ১০ কিমি দূরে মূল রাজপ্রাসাদ ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যাবার পর তৎকালীন রাজা মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য ১৮৯৯-১৯০১ সালের মধ্যে এই প্রাসাদটি তৈরী করেন যা তখন থেকে এই রাজপরিবারের (৮০০ বছরের পুরনো) শাসনকেন্দ্র ছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রাসাদের নামকরণ করেন! এই প্রাসাদের নির্মাণশৈলী এবং স্থাপত্য পরিকল্পনা সবাইকে মুগ্ধ করতে বাধ্য! সেখান থেকে গেলাম মহারাজা বীর বিক্রম কলেজে। কলেজ বিল্ডিং এর ঐতিহাসিক নির্মাণশৈলী, ঝকঝকে তকতকে পরিবেশ সত্যিই ভাল লাগার মত। ত্রিপুরার হস্তশিল্প বিখ্যাত। আগরতলা শহরের মধ্যেই কিছু দোকান আছে (যেমন পূর্বাশা এম্পোরিয়াম) যেখানে এধরনের জিনিসপত্র পাওয়া যায়।

মেলাঘরের নীরমহল
পরের দিন বিকেলে (১০ এপ্রিল) যাত্রা করলাম মেলাঘরের নীরমহলের উদ্দেশ্যে যা ত্রিপুরার অন্যতম প্রধান ট্যুরিস্ট আকর্ষণগুলোর মধ্যে একটি। আগরতলা শহর হতে প্রায় ৫৫ কিমি দূরে রুদ্রসাগরের মাঝে ১৯৩০ সালে মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যের আমলে তৈরী এই নীরমহল প্রসাদ বা ওয়াটার প্যালেস। রুদ্রসাগর মূলত একটি বিশাল দীঘী যার আয়তন প্রায় ৫.৩ বর্গ কিমি। ১৯২১ সালে মহারাজ এই বিশাল প্রাকৃতিক হ্রদের মাঝে এই প্রাসাদ নির্মাণের পরিকল্পনা করে... যা পরবর্তীতে কলকাতার নির্মাণ সংস্থা মার্টিন অ্যান্ড বার্ণ-এর মাধ্যমে নির্মিত হয় হিন্দু ও মুসলিম নির্মাণ শৈলীর সংমিশ্রণে। এই নীরমহল ছিল মূলতঃ রাজার গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপন কেন্দ্র। সমগ্র ভারতে সর্বমোট দুটি পানিবেষ্ঠিত মহল আছে যার মধ্যে এটি আকারে বড়। অপর মহলটি রাজস্থানে অবস্থিত। নীরমহলে সর্বমোট ২৪টি কক্ষ আছে। প্রাসাদের পৌঁছানোর জন্য আপনাকে নৌকায় প্রায় ৩০ মিনিটের যাত্রা করতে হবে। মেলাঘর সম্পর্কে আরও একটি বিষয় সবারই জানা প্রয়োজন (আমরা সবাই জানি, তাও একবার মনে করিয়ে দেওয়া আরকি...), ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই মেলাঘরেই ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় ট্রেনিং সেন্টার!

ঊনকোটি!
১১ তারিখ সকালে গেলাম পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা ঊনোকটি যা আগরতলা শহর থেকে প্রায় ১৭৮ কিমি দূরত্বে ঊনকোটি জেলার কৈলাসহরে রঘুনন্দন পাহাড়ে অবস্থিত। ঊনকোটি নামটি (কোটি হতে এক কম) একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বলা হয়ে থাকে এখানে এক কোটি অপেক্ষা একটি কম সংখ্যাক দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা আছে। মতভেদে ৭ম হতে ৯ম শতাব্দীর মধ্যে এই ভাষ্কর্যসমূহ খোদাই করা হয়। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা জটাধারী শিব, ৩০ ফুট উঁচু কালভৈরবের মূর্তি, এছাড়া গণেশ, দুর্গা, বিষ্ণু, রাম, রাবণ, হনুমান এবং শিবের বাহন নন্দীর মূর্তি- সত্যিই আকর্ষনীয়! ঊনকোটির মূর্তিগুলি নিয়ে একাধিক কাহিনি প্রচলিত আছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মহাদেব-এর কাহিনী। কথিত আছে শিব একবার দেবতাদের নিয়ে (সর্বমোট সংখ্যা ছিল এক কোটি) ত্রিপুরার হতে বারানসী যাচ্ছিলেন এবং পথিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে যাবার কারনে তারা রাত্রিযাপন করেন এই রঘুনন্দন পাহাড়ে। ঠিক হয় পরের দিন সূর্যোদয় হবার আগে সবাই বারানসীর উদ্দেশে যাত্রা করবে। পথপরিশ্রমে ক্লান্ত দেবতারা গভীর নিদ্রায় পতিত হন এবং পরের দিন মহাদেব ছাড়া অন্য কোনো দেবতাদের নিদ্রাভঙ্গ হল না। মহাদেব বিরক্ত হয়ে একাই বারানসীর উদ্দেশে রওনা দিলেন এবং অন্যান্য দেবতাদের গভীর ঘুম আর ভঙ্গ হল না এবং তারা অনন্তকালের জন্য পাথর হয়ে থাকলেন।আসল ইতিহাস কি সেটি যদি বিবেচনা নাও করা যায় তারপরও এই স্থানটি একটি দেখার মত জায়গা যার প্রাকৃতিক পরিবেশ সবাইকে মুগ্ধ করার মত!

আগরতলা শহরের একটি দোকানে
ত্রিপুরার অন্যান্য দেখবার মত স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে অভয়ারণ্য সিপাহজলা যা আগরতলা হতে ২৫ কিমি দূরত্বে। এছাড়া আগরতলা থেকে ২২৫ কিমি দূরে ত্রিপুরার একমাত্র চিরবসন্তের জম্পুই শহর, যদিও আমাদের সময় স্বল্পতার কারনে যাওয়া হয়নি। রাজ্যপালের বাসভবন কুঞ্জবন প্রাসাদটিও খুবই সুন্দর যেখানে শেষবার ত্রিপুরায় এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন। তবে ত্রিপুরায় এলে রবীন্দ্রনাথ সচরাচর যে বাড়িটিতে থাকতেন সেটি হল মালঞ্চ নিবাস এবং এখানে বসেই রচনা করেছিলেন তাঁর ‘বিসর্জন’ নাটকটি। আগরতলা শহরের মধ্যে আরও রয়েছে বেশকিছু প্রাচীন মন্দির ও মসজিদ (আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম, ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির, উমা-মহেশ্বর মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, বেনুবন বিহার, গেদু মিঞার মসজিদ, চতুর্দশ দেবতার মন্দির ইত্যাদি) যা নজর কারবে। এছাড়া শহরের মধ্যেই ঘোড়া দৌড়ের মাঠ, সুকান্ত একাডেমী ভাল লাগবে। তাছাড়া শহরের রাস্তাগুলোর উপর অস্থায়ী দোকানের পানিপুরি, বাদাম-কিসমিস মেশানো লাচ্ছি, আইসক্রিম চেখে দেখতে ভুলবেন না! তাছাড়া আগরতলায় মূল কেনাকাটার মার্কেট বিগবাজারে কেনাকাটা করতে খুব খারাপ লাগার কথা নয়।

ত্রিপুরা সম্পর্কে আর একটু কথা না বললেই নয়... সেভেন সিস্টারের অন্তর্ভুক্ত ত্রিপুরা ভারতের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য যার প্রায় ৭০ ভাগই পাহাড়। একটি বিষয় দেখে সত্যি খুবই মুগ্ধ হয়েছিলাম সেটি হল পাহাড়ী রাস্তার দু’পাশে শুধু বন আর বন... তারপরও একটু পর পর সাইনবোর্ডে বন নিয়ে গণসচেতনতা মূলক প্রচার (যেমন, ‘বনের বিলুপ্তি জীবনের সমাপ্তি’, ‘সবুজ দেশ সবুজ বন সবুজ হোক সবার জীবন’ ইত্যাদি)। আরও একটি বিষয় অনেকেই হয়ত জানেন না যে ব্রিটিশ শাসন আমলেও ত্রিপুরা কিন্তু একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল! এরা কখনই পরাধীন ছিল না!

No comments:

Post a Comment