পাহাড় ঘেরা হ্রদের শহর রাঙ্গামাটি

পাহাড় পানির রাঙ্গামাটি...
শেষবার যখন রাঙ্গামাটি এসেছিলাম সেটি ছিল ২০০৫ সাল (২৭–২৮ সেপ্টেম্বর), ফিশারীজ বিভাগের ছাত্র হিসেবে শিক্ষাসফরে আর এবার যাচ্ছি ঠিক ১০ বছর পর ২০১৫ সালে (১১ অক্টোবর), ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষক হিসেবে!  আমাদের ট্যুর বাসটি যখন চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল তখন সূর্য্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে এবং সন্ধ্যা হতে আর অল্প কিছুক্ষণ বাকি। ফিশারীজ ৩য় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের প্রায় সবারই এই প্রথম রাঙ্গামাটি সফর যার করনে কারোরই উৎসাহের কোথাও কোন কমতি নেই। যদিও আমি আগেও একবার রাঙ্গামাটি এসেছি তারপরও আমারও অনুভূতি ওদের কারো থেকে কোন অংশে কম নয়! কতদিন পর! চট্টগ্রাম জেলার সীমানা পর করে রাঙ্গামাটি জেলায় ঢোকার আগেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল, ফলাফল স্বরূপ আশেপাশের দৃশ্য দেখার জন্য গাড়ির হেডলাইটের আলোর উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। দু’পাশের পাহাড়ি পরিবেশ, গাছপালা, সামনের উঁচু-নিচু রাস্তা সবকিছু আমাদের বাসের যাত্রীদের দীর্ঘ এবং প্রায় বিরতিহীন ট্যুরের ক্লান্তিকে সাময়িকভাবে হলেও ভুলিয়ে দিল, প্রায় সকলেই তখন নিজ নিজ সিটে না বসে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখার চেষ্টায় মত্ত। রাস্তার প্রতিটি উঁচু-নিচু ঢাল আসা মাত্রই বাসের মধ্যে তখন উচ্ছাসসূচক শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

হঠাৎই রাস্তার মাঝে ‘বিজিবি’র ব্যারিকেড! বাস থেমে গেল! অফিসার জানাল যে কিছুক্ষণ আগে আমাদের বাসটি নাকি ‘বিজিবি’র অন্য একটি টীমের সংকেত অমান্য করে সোজা চলে এসেছে! বুঝলাম যাত্রাপথে আনন্দটা বোধহয় একটু বেশীই হয়ে যাচ্ছে! যাহোক তাদেরকে আমাদের ট্যুর এর বিস্তারিত জানিয়ে পুনরায় আবার যাত্রা শুরু হল। রাঙ্গামাটি পৌঁছে সোজা নির্ধারিত হোটেলে। রাতের খাবারের জন্য আবাসিক হোটেলের পাশেই একটি ছোট রেস্তরায় আগে থকেই কথা বলা ছিল। হোটেল রূমে ব্যাগবোচকা রেখে খাবারের জন্য বেরতে একটু দেরীই হয়ে গেল। পথিমধ্যে কিছু ছাত্রছাত্রী জানাল যে আমাদের নির্ধারিত রেস্তরার খাবারের মান নাকি ভাল না! রাঙ্গামাটির এই এক সমস্যা, এখানে ভালমানের খাবারের দোকানের চরম অভাব। খাবারের কথা শুনেই আমরা পাশের অন্য একটি হোটেলে ঢুকে পরলাম। সত্যি কথা বলতে কি পরিবেশ এটারও খুব যে ভাল তা নয় কিন্তু কাঁচকি মাছের তরকারি... আহা... রান্না খুবই ভাল। রাঙ্গামাটি এসে যদি কাপ্তাই লেকের কাঁচকি মাছই না খাওয়া যায় তাহলে তো ট্যুরটাই ব্যর্থ।
রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত ব্রিজ... জাগ্রত (২০০৫ সালে তোলা) এবং ডুবন্ত (২০১৫ সালে তোলা)


নৌকার গলুই-এ বসে আমি...
পরদিন (১২ অক্টোবর) সকালে দেখি কিছু ছাত্রছাত্রী খুব আগ্রহ সহকারে হোটেলের ছাদে উঠানামা করছে! আমিও মহা আগ্রহ নিয়ে চলে এলাম সেখানে... অসাধারণ দৃশ্যপট! দূরের পাহাড়, লেকের পানি, গাছপালা সবমিলিয়ে সত্যিই অতুলনীয়! এবং স্বভাবিকভাবেই সবাই তখন ফটোসেশনে ব্যস্ত! কিছুক্ষণ পর কাপ্তাই লেকের বুক চিরে আমাদের নৌকায় যাত্রা শুরু হল। এই কাপ্তাই লেক হল একটি কৃত্রিম হ্রদ বা ইমপাউন্ডমেন্ট যা ১৯৬০ সালে পরিকল্পিতভাবে কর্ণফুলী নদীতে বাধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে তৈরী করা হয়। আমাদের আপাত গন্তব্য রাঙ্গামাটির বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রিজ। যদিও ইতোমধ্যেই জেনে গিয়েছিলাম যে ঝুলন্ত ব্রিজ এখনও লেকের পানির নীচে ডুবন্ত অবস্থায়ই আছে! কাপ্তাই হ্রদের পানি এখনও যথেষ্ট পরিমাণে কমে যায় নি যাতে করে ব্রিজটি পানির উপরে জেগে উঠবে। ব্রিজের কাছে যখন পৌঁছালাম তখন দেখলাম ব্রিজটি এখনও প্রায় অর্ধমানুষ গভীরতায় নিমজ্জিত। স্পষ্ট মনে পড়ে গেল ১০ বছর আগে প্রায় একই সময়ে ব্রিজটি পানির উপরে ছিল এবং কি যে সুন্দর লাগছিল এটি! রাঙ্গামাটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণগুলোর মধ্যে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্দ্যগে হ্রদের উপরে দুটি পাহাড়ের সংযোগ হিসেবে নির্মিত এই ৩৩৫ দীর্ঘ ঝুলন্ত ব্রিজ অন্যতম। এখানে স্থানীয় পাহাড়ীদের বেশ কিছু দোকান আছে যেখান থেকে বার্মিজ আচার বা স্থানীয় হস্তশিল্প ক্রয় করতে পারেন যে কেউ। পাহাড়ী আখের স্বাদও নিতে পারেন এখানে!

সুবলং ঝর্ণা, ২০১৫ সাল
সুবলং ঝর্ণা, ২০০৫ সালে তুলেছিলাম
ডুবন্ত ব্রিজের পর আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম সুবলং (অনেকেই ‘শুভলং’ বলেন কিন্তু শব্দটি আসলে ‘সুবলং’) ঝর্ণার উদ্দেশ্যে, পরিকল্পনাটি মূলতঃ এরূপ: মাঝপথে পেদা টিং টিং রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে সুবলং ঘুরে ফিরে আসার পথে দুপুরের খাবার খাওয়া। কিন্তু পেদা টিং টিং এ যেয়ে মেনু পছন্দ হল না! ইতোমধ্যে জানা গেছে কাপ্তাই লেকের মাঝে নতুন আরেকটি রেস্তরা হয়েছে যার নাম ‘মেজাং’- সুতরাং সেখানে গমন এবং খাবারের অর্ডার দিয়ে আমরা সুবলং যাত্রা করলাম। সুবলং যখন পৌঁছালাম তখন বেলা ১.৩০টা এবং কিছুটা হতাশও হলাম! কারন হ্রদের পানি বেশী থাকায় তা ঝর্ণার পানির সাথে এক হয়ে গেছে এবং ঝর্ণার সৈন্দর্য্যকে প্রায় পুরোটাই ম্লান করে দিয়েছে। ২০০৫ সালে যখন এসেছিলাম কি পিচ্ছিলই না ছিল এই স্থানটি যা আজ সবটুকুই পানির নীচে! মনে আছে দেলোয়ার স্যার সেবার এখানে পা পিছলে আছাড় খেয়েছিলেন! যাহোক সুবলং ঝর্ণার এই আপাত সৈন্দর্য্যও ছেলেমেয়েদের থামিয়ে রাখতে পারল না। অনেকেই সোজা নেমে গেল পানিতে এবং পৌঁছে গেল ঠিক ঝর্ণার নীচে! বর্ষায় এই ঝর্ণার জলধারা প্রায় ৩০০ ফুট উপর থেকে নিচে আছড়ে পড়ে। সুবলং ঝর্ণাটি রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলায় অবস্থিত যার দূরত্ব রাঙ্গামাটি শহর হতে প্রায় ২৫ কিমি। ঝর্ণাটি হতে একটু দূরেই সুবলং বাজার যেখানে একটি সেনা ক্যাম্পও রয়েছে। অনেকে দুপুরের খাবার এই বাজারেও খেয়ে থাকেন। রাঙ্গামাটি সদর হতে কাপ্তাই লেকের উপর দিয়ে সুবলং যাত্রা নিঃসন্দেহে সবারই উপভোগ করবেন এবং এরকম যাত্রার তুলনা মেলা ভার!

ছোট্ট দ্বীপের মেজাং রেস্তরা
সুবলং ঝর্ণা দেখে ফিরতি পথে সবাই চুপচাপ! লম্ফঝম্ফ করে সবাই তখন যতটা না ক্লান্ত ঠিক ততটাই ক্ষুধার্ত। সবাই নৌকায় বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন কাপ্তাই লেকের সেই দ্বীপের দেখা মিলবে যেখানে আছে মেজং রেস্তরা! অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হল এবং ৩.৩০ নাগাদ আমরা সেখানে পৌঁছালাম। পরের অংশটুকু সহজেই অনুমেয়! তবে খাবারের স্বাদের কথা কিছু না বললে এই রেস্তরার পরিচালকগণের (সবাই ছাত্র, বন্ধুরা মিলে এই ব্যবসা দাড় করিয়েছে) সাথে অন্যায় করা হবে। ডুবো তেলে কাঁচকি মাছ ভাজি, বাঁশের মাঝে মুরগীর মাংশ রান্না (ব্যাম্বু চিকেন)... মনে হলেই এখনও মুখে লালা ঝড়ার উপক্রম হয়! তবে কচি বাঁশ রান্নাও খাবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু বছরের এ সময়টাতে এটি হয় না, কি আর করা... খাবার শেষে এই দ্বীপেই এখানে সেখানে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব হল। দ্বীপের এক পাশেই বেড় জাল দিয়ে হ্রদে মাছ ধরা হচ্ছিল এবং প্রচুর সংখ্যক জলজ পাখি বারবার ছোঁ মেরে জালের সীমানার মধ্যে থেকে মাছ ধরছিল। সময় তখন প্রায় বিকেল ৫টা, বেলা আর বেশিক্ষণ নেই! আমাদের এবার যেতে হবে... তাড়াহুড়ো করে সবাই আবার নৌকায় উঠলাম এবং নৌকা এবার রওনা হল রাজবন বিহারের উদ্দেশ্যে। আমরা যখন রাজবন বিহার পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, গোধুলীর আলোটুকুও নিভু নিভু। সারাদিনের ক্লান্তি, কিছুক্ষণ আগের অতি উপাদেয় ভোজন-এর পর অনেকেই নৌকার ঘাট হতে রাজবন বিহারে প্রবেশের খাড়া সিড়ি অতিক্রম করার সাহস অর্জন করতে ব্যর্থ হল। আমার মত কিছু অতি আগ্রহীরাই কেবলমাত্র অতি স্বল্পসময়ের মধ্যে সমস্ত ক্লান্তি ভুলে সমগ্র বিহারটি দেখে ফিরল। বিহারটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হলেও বহু পর্যটক প্রতিদিনই ভিড় করেন এখানে। এ বিহারে দেখা যাবে স্বর্গীয় সিড়ি, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ধ্যানের বিশাল গর্ত এবং অবশ্যই বিখ্যাত বৌদ্ধ ধর্মগুরু সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভন্তে)'র মৃতদেহ যা ভক্তদের দেখার জন্য সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে! তবে এখানে ঘোরাঘুরির সময় বানর হতে কিন্তু সাবধান!

হ্রদের মাঝে মাছ ধরার দৃশ্য
প্রায় অন্ধকার হয়ে যাবার কারনে রাজবন বিহারের ঠিক পাশের ছোট্ট দ্বীপে অবস্থিত চাকমা রাজার রাজবাড়িটিতে আর যাওয়া হলনা। রাজবাড়ির পাশ দিয়ে নৌকা পার হয়ে যাবার সময় একটু বাড়ির চেহারাটি দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। তবে যারা বাংলা নববর্ষের শুরুতে এখানে আসবেন তারা ঐতিহ্যবাহী রাজপুণ্যাহ্ অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবেন বিনা পয়সায়! চাকমাদের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানও এসময় চলতে থাকে।
হোটেলে ফেরার পর শরীরে আর বল পাচ্ছিলাম না কিন্তু থামলে চলবে কেন? কোনরকম একটু ফ্রেস হয়েই হাঁটতে হাঁটতে স্থানীয় মার্কেটে চলে এলাম। দোকানগুলো তখনও খোলা ছিল। রাঙ্গামাটিতে এসে গতবারও এই মার্কেটে ঢুঁ মারা হয়েছিল। ঝটপট কিনে ফেললাম বেশ কিছু জিনিসপত্র যার মধ্যে অবশ্যই আছে কিছু স্যুভেনির। রাত প্রায় ১০টা বেজে যাচ্ছে, ফিরতে হবে... কাল সকালেই আবার বান্দরবানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে...

২০০৫ সালে দু’দিনে আর এবারও স্বল্প সময়ে রাঙ্গামাটি ভ্রমণ... ভালমত সময় নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর আক্ষেপটা থকেই গেল। আসলে রাঙ্গামাটি ভালমত ঘুরে বেড়ানোর জন্য প্রয়োজন বেশ কদিন। এখানে আরও দেখার মত স্থানসমূহ হল উপজাতীয় জাদুঘর (রাঙ্গামাটি শহর), কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্পিলওয়ে (কাপ্তাই), কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান (কাপ্তাই), টুকটুক ইকো ভিলেজ (রাঙ্গামাটি সদরের বালুখালী ইউনিয়ন), যমচুক (নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সাপেক্ষে!  বন্দুক ভাংগা ইউনিয়ন) এবং আরও অনেক কিছু।

১৩ অক্টোবর সকালে আমাদের বাস রওনা দিল বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। পথে কর্ণফুলী পেপার মিল দর্শনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। স্কুলে থাকা অবস্থায় বইপত্রে অনেক পড়েছি এই মিলের কথা। রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় ১৯৫১ সালে পাকিস্তান আমলে তৈরী এই কাগজ মিলটি যেখানে কাঁচামাল হিসেবে মূলতঃ বাঁশ ব্যবহৃত হয়।  রাঙ্গামাটি হতে বান্দরবানের রাস্তাটিও কিন্তু অসাধারণ। অপ্রশস্ত রাস্তা, কিন্তু চারপাশের চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনাকে অবশ্যই মুগ্ধ করবে যদি আপনি আপনার গাড়ির চালকের উপর বিশ্বাস রাখতে সক্ষম হন!

No comments:

Post a Comment