গবেষণা প্রবন্ধ, ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর এবং অন্যান্য

অনেক দিন থেকেই এই বিষয়টির উপর একটি লেখা লিখব লিখব করছি কিন্তু হয়ে উঠছিল না। লেখার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যারা গবেষণার সাথে যুক্ত আছেন তাদের জন্য। তবে বাংলাদেশের গবেষকদের জন্য বিষয়গুলো একটু বেশীই গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমি লক্ষ করেছি বেশীরভাগ গবেষকের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে কোন ধারনা নেই বা ধারণা অস্পষ্ট। অনেক ক্ষেত্রেই অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোথাও নিজের গবেষণা প্রবন্ধ (জার্নাল আর্টিক্যাল / পেপার) সম্পর্কে ভুল তথ্য (বিশেষ করে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর সম্পর্কিত) উপস্থাপন করেন যা অন্যদের ভুল পথে পরিচালিত বা বিভ্রান্ত করে। আমি খুবই সংক্ষেপে কিছু বেসিক বিষয়গুলি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।


আপনার গবেষণা কোন জার্নালে প্রকাশ করবেন? 
অবশ্যই কোন স্বীকৃত পিয়ার রিভিউড (Peer Reviewed) জার্নালে। তবে আজকাল সব জার্নালের ওয়েবসাইটেই Peer Reviewed লেখা থাকে, সুতরাং আমাদের সাবধান হতে হবে। যেসব জার্নাল ১০ বা ১৫ দিন বা ১ মাসেই টাকার বিনিময়ে কোন রকম রিভিউ ব্যতীত পেপার পাবলিশ করে তাদের থেকে দুরে থাকতে হবে। সমগ্র বিশ্বে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মানসম্পন্ন জার্নালগুলোর তালিকা করে Clarivate Analytics, যারা আগে Thomson Reuters (ISI) নামে পরিচিত ছিল । আপনি এদের ওয়েবসাইটে সহজেই ভাল জার্নালগুলোর তালিকা (Master Journal List) পেয়ে যাবেন। চেষ্টা করুন Web of Science Core Collection ডাটাবেজে থাকা জার্নালগুলো (Science Citation Index Expanded, Social Sciences Citation Index, Arts & Humanities Citation Index, and Emerging Sources Citation Index) টার্গেট করতে কারণ সেগুলোই সবচেয়ে সেরা। সুতরাং পেপার কোন জার্নালে পাঠানোর আগে জার্নালের নামটি এখানে খুঁজে দেখুন, নাম না থাকলে সেখানে পেপার সাবমিট না করাই ভাল। এছাড়া আপনি স্কুপাস (Scopus) ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত জার্নালও টার্গেট করতে পারেন তবে Clarivate Analytics-ই সবচেয়ে  গ্রহণযোগ্য কারণ এটিতে অপেক্ষাকৃত কমসংখ্যক জার্নাল অন্তর্ভুক্ত (১২০০০ এর আশেপাশে) যেখানে স্কুপাস ডাটাবেজে ২১০০০ এর ওপরে জার্নাল আছে। এছাড়াও সামাজিক বিজ্ঞান, কলা ও মানবিক বিষয়ের জার্নালগুলোর ক্ষেত্রে স্কুপাস ডাটাবেজের কভারেজ দুর্বল।

ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর
কোন জার্নালের কোন নির্দিষ্ট সালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর হল বিগত দুই বছরের প্রকাশিত সমস্ত পেপার এবং সেই পেপারগুলোর মোট সাইটেশন (অন্য কোন পেপারে ব্যবহৃত হওয়া) এর একটি পরিসংখ্যান। উদাহরণ এর মাধ্যমে ব্যাপারটি সহজেই পরিষ্কার হবে। ধরা যাক একটি জার্নালে ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে মোট ৫০টি পেপার প্রকাশিত হয়েছে এবং এই ৫০টি পেপার ২০১৮ সালে মোট ২০০ বার অন্য কোন পেপারে ব্যবহৃত (সাইটেশন) হয়েছে। তাহলে ঐ জার্নালের ২০১৮ সালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর হবে ২০০/৫০ = ৪.০০০, খুবই সহজ তাই না?

তবে আমাদের স্পষ্টভাবে জানা প্রয়োজন যে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর শুধুমাত্র Clarivate Analytics-ই প্রদান করে। অনেকেই স্কুপাস এর Scientific Journal Rankings (SJR) স্কোরকে Clarivate Analytics-এর ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের সাথে গুলিয়ে ফেলেন যেটি সঠিক নয়। উন্নত বিশ্বে কেউ স্কুপাস ফ্যাক্টর নিয়ে মাথা ঘামায় না, তারা যদি কথা বলে তাহলে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর নিয়েই বলে। যদিও সাম্প্রতিককালে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর এর ধারনাই উন্নত বিশ্বে কমজোরি হয়ে যাচ্ছে। অনেক ভাল জার্নাল (যাদের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর আছে) তাদের ওয়েবসাইটে তো বলেই দিচ্ছে যে তারা ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরে বিশ্বাসী না!

আরও একটি ভুল আমরা করি সেটি হল দুটি জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর তুলনা! সঠিকভাবে তুলনা তখনই হবে যখন দুটি জার্নালই একই বিষয়ের / গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত হবে। উল্লেখ্য যে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরধারী সমস্ত জার্নালগুলো বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ভাগ করা হয়ে থাকে (এবং কোন কোন জার্নাল একাধিক গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে)। সুতরাং ফিশারীজের ২.০০ ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের একটি জার্নালের সাথে মেডিকেলের ৫ ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরধারী জার্নালের তুলনা করা যাবে না কারণ ফিশারীজের জার্নালটি হয়ত ২ ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর নিয়ে ফিশারীজের মোট জার্নালের মধ্যে ১০ম কিন্তু মেডিকেলের ঐ জার্নালটি ৫ ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর নিয়েও মেডিকেলের জার্নালের মধ্যে ৫০তম হতে পারে! সুতরাং তুলনা যদি করতেই হয় তাহলে সবসময় একই বিষয়ের জার্নালগুলোর মধ্যে করতে হবে। অন্যদিকে স্কুপাস তাদের জার্নালগুলোকে কোয়ারটাইলের (Quartile) উপর ভিত্তি করে Q1 থেকে Q4 পর্যন্ত ভাগ করেছে, তবে আগেই উল্লেখ করেছি যেহেতু স্কুপাস ডাটাবেজে অনেক বেশী জার্নাল অন্তর্ভুক্ত সুতরাং এই জার্নালগুলো টার্গেট করলে Q1 বা Q2 ক্যাটেগরির জার্নালগুলো টার্গেট করাই ভাল। এর আরেকটি কারণ হল এই জার্নালগুলোর বেশীরভাগই Web of Science (WoS) ডাটাবেজেও অন্তর্ভুক্ত।

অনেক প্রিডেটরী জার্নাল (যারা টাকার বিনিময়ে কোন মানসম্মত রিভিউ ছাড়াই পেপার প্রকাশ করে) তাদের ওয়েবসাইটে ভুয়া ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর প্রকাশ করে এবং তা দেখে আমাদের দেশের অনেক গবেষক প্রতারিত হন, আমি নিজেও অজ্ঞতার কারণে এই ভুলগুলো করেছি একসময়! ভারত হতে প্রকাশিত বেশিরভাগ জার্নালই এই ধরনের।

অন্যান্য (গবেষক প্রোফাইল)
আমাদের অনেকেরই বিভিন্ন গবেষণা সম্পর্কিত ওয়েবসাইটে প্রোফাইল আছে এবং এসকল ওয়েবসাইট প্রদত্ত স্কোরগুলোকে নিজেদের মানদণ্ড অন্যদের সামনে হিসেবে তুলে ধরি। এক্ষেত্রে আমরা কি নিচের তথ্যগুলো সম্পর্কে অবগত আছি?

Google Scholar: বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় এবং বেশ গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এর সবচেয়ে খারাপ দিক হল অনেক গবেষকের প্রোফাইলে অন্য গবেষকের পেপার অটোমেটিক ভাবে যোগ করে দিয়ে (নামের মিল থাকার কারণে) স্কোর বাড়িয়ে দেয়। অনেকেই নিজের প্রোফাইল থেকে এসব অপসারণ করেন না কারণ তাঁর স্কোর কমে যাবে বলে কিংবা অনলাইনে তারা খুব একটা সক্রিয় নন!

ResearchGate: রিসার্চগেট সম্পর্কে আমাদের স্পষ্টভাবে জানতে হবে যে এটি গবেষকদের একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম! রিসার্চগেটও গবেষকদের স্কোর প্রদান করে যেটি সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রহণযোগ্য একটি স্কোর কারণ এখানে শুধু আপনার গবেষণার জন্য আপনি স্কোর পাবেন না, আপনি কোথাও কমেন্ট করলে বা প্রশ্ন করলেও আপনার স্কোর বাড়তে থাকবে! আপনার একগাদা ভাল ভাল পেপার থাকলেও আপনার স্কোর একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার পর বাড়বে না বললেই চলে। সেক্ষেত্রে আপনাকে কমেন্ট করে বা প্রশ্ন করে করে নিজের স্কোর বাড়াতে হবে!

ORCID: বর্তমানে ভাল জার্নালগুলোতে পেপার প্রকাশের সময় আপনার কাছে আপনার ORCID ID জানতে চাওয়া হবে। উন্নত দেশগুলোর প্রায় প্রতিটি গবেষকেরই এই প্রোফাইল আছে কিন্তু আমাদের দেশের গবেষকদের মধ্যে এই সংখ্যা অল্প।

Publons: আমাদের দেশের বেশিরভাগ গবেষকই সম্পর্কে অবগত নন কিন্তু এটিই এখন পর্যন্ত সেরাদের অন্যতম। এখানে প্রতিটি তথ্য ভেরিফিকেশনের পরেই আপনার প্রোফাইলে প্রদর্শিত হবে। আমি সবাইকে পরামর্শ দিব এখানে প্রোফাইল খোলার জন্য।

যদিও এত স্বল্প কথায় এই জটিল বিষয়গুলো তুলে ধরা খুবই কঠিন কিন্তু আমি আশা করছি লেখাটি কিছুটা হলেও অনেকের ধারনার পরিধি বৃদ্ধি করবে যাতে করে তারা নিজেদের এবং অন্যের গবেষণার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারে। সবশেষে এটুকু না বললেই নয় যে একজন ভাল গবেষকের কাছে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের চেয়ে গবেষণার / পেপারের মান কেমন সেটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ! উন্নত বিশ্বের অনেক শিক্ষক এবং গবেষকের সাথে উঠবস করে সেটির গুরুত্ব খুব ভাল মতই বুঝেছি। সুতরাং ভাল ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরধারী জার্নালে পেপার করেছেন বলে আপনি ভাল গবেষক বিষয়টি তেমন নাও হতে পারে! এক্ষেত্রে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর নেই এমন জার্নালের পেপারও ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরধারী জার্নালে প্রকাশিত পেপারের চেয়ে উপরে স্থান পেতে পারে। সুতরাং ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর এর পিছনে না দৌড়িয়ে গবেষণার মানের দিকের গুরুত্ব দেয়া বেশী প্রয়োজন। অনেকেরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তথাকথিত ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরধারী জার্নালে পেপার থাকার পরও হয় ইংলিশ কান্ট্রিগুলোতে স্কলারশিপ হয় না, এর দুটি কারণ (১) গবেষণা বিষয়বস্তুর এসকল দেশে আর তেমন গুরুত্ব নেই অথবা (২) ইংরেজির ন্যূনতম স্কোর নেই! আমার একটি একান্ত নিজস্ব ধারনা আছে আর তা হল আপনার যদি মানসম্মত পেপার ও ইংরেজির ন্যূনতম স্কোর থাকে এবং আপনি যদি বলেন ইংলিশ কান্ট্রিগুলোতে স্কলারশিপ পাচ্ছি না তবে আমি বলব আপনি মিথ্যে কথা বলছেন!


No comments:

Post a Comment