ওয়ার্ক শ্যাডোয়িং

ডায়েরী লেখা আমার ছেলেবেলার অভ্যাস! স্কুলে থাকাকালীন সময় থেকেই লিখি, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর প্রথম কিছুদিন লিখলেও পরে বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম কিছু কারনে। ইংল্যাণ্ডে আসার পর থেকে ‘বিলেতের ডায়েরী’ নামে আবার লেখা শুরু করেছি! উদ্দেশ্য বেঁচে থাকলে শেষ জীবনে গিয়ে জীবনের ফেলে আসাদিনগুলো একটু স্মরণ করব! বর্তমানে আমার ডায়েরী লেখার ধরন একটু আলাদা, আমি কাগজে কলমে লিখি না, লিখি কম্পিউটারে! যদিও আমার ব্যক্তিগত, তবুও আজকের ডায়েরীর পাতাটি পোষ্ট করলাম এখানে! অনেকে আমার লেখায় মনক্ষুন্ন হতে পারেন কিন্তু এটাই বাস্তবতা...

৫ জুলাই ২০১৯, শুক্রবার; ডারহাম, যুক্তরাজ্য

আজ ঘুম থেকে উঠতে একটু বেশীই দেরী হয়ে গিয়েছিল। ল্যাবে যাব কি যাব না ঠিক মনস্থির করতে পারছিলাম না তারপর হঠাৎ মনে হল যে এখন যে এনালাইসিস করছি তার জন্য কম্পিউটারের দুটি মনিটর হলে কাজে খুব সুবিধে হবে, সুতরাং সকালের ও দুপুরের খাবার তৈরি করে ক্যাম্পাসে চলে আসলাম। আজ দেখছি আমাদের গ্রুপের কেউই আসেনি ল্যাবে। খুবই স্বাভাবিক, আমিই বোধহয় সবচেয়ে বেশী অনুপস্থিত থাকি ল্যাবে!

ঘড়িতে ১৭১৫। গত ১০ মিনিট ধরে আমি একটি বিষয় চিন্তা করছি। একটু আগে আমাদের ডিপার্টমেন্টে যারা ইকোলজির কাজ করে তাদের সবার কাছে একটি ইমেইল এসেছে। ইমেইলটি পাঠিয়েছে স্থানীয় স্কুলের এ-লেভেলের একজন ছাত্র। তার বক্তব্য হল সে বর্তমানে জীববিজ্ঞান, রসায়ন এবং গণিত অধ্যয়ন করছে এবং সে একাডেমিক লাইনে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চায়। এজন্য সে ‘Work Shadowing’ (সহজভাবে কারো সাথে থেকে তার কাজে সহায়তার মাধ্যমে নিজে হাতে কলমে কাজ শেখা) করতে ইচ্ছুক! বর্তমানে সে একাডেমিক গবেষণার যুক্ত কারো সাথে থেকে ডেটা এনালাইসিস বা পরিসংখ্যানিক টেস্টসমূহ শিখতে এবং ফিল্ডওয়ার্কে সাহায্য করতে ইচ্ছুক! মনে হয়ে গেল আমাদের বিভাগের প্রথম দিকের সময়গুলোর কথা, আমরা ব্যবহারিক কোর্স বা গবেষণাগুলো কত আগ্রহ করেই না করতাম! এধরনের সুযোগ ছিল না কিন্তু বিভাগের কিছু শিক্ষকের কাছে থেকেই অনেককিছু শিখার সুযোগ ছিল। বর্তমানে অবস্থা বোধহয় বিপরীত! আজকালকার ছাত্ররা কিভাবে পরিশ্রম না করে ভাল রেজাল্ট করা যাবে তার জন্য যে সময় ব্যয় করে সেটুকুও যদি কোন একাডেমিক কিছু শেখার কাজে ব্যয় করত তাতেই কাজ হয়ে যেত। যেসকল শিক্ষকের কাছে গেলে কাজ না করেও থিসিস করা যাবে তাদের ফেলোর অভাব হয় না আর যাদের কাছে কাজে ফাঁকি দেয়া কঠিন তারা ছাত্রছাত্রী পায় না!

বাড়ি ফিরলাম। আর একটি ঘটনায় এখানে একটু যোগ করা দরকার। আমার চাইনিজ ল্যাবমেট এর ফিল্ডওয়ার্ক চলছে, আমাদের ফিল্ডওয়ার্ক খুবই কঠিন (উদাহরণ, পিঠে প্রায় ৪০ কেজি ওজনের ইলেকট্রোফিশিং জেনারেটর নিয়ে ঘুরতে হয়)। ল্যাব থেকে বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ আগে ও ফিরল ফিল্ডওয়ার্ক থেকে, ওর সাথে কাজ করছে এক আণ্ডারগ্রাড, ২য় বর্ষে পড়ে ডারহামে, সিঙ্গাপুরের ছেলে। সেও শুধুমাত্র কাজ শেখার জন্য এত কঠিন কাজে সহায়তা করছে এবং তাকে এই সুযোগ করে দেয়ার জন্য খুবই খুশি! গত বছরের গ্রীষ্মে আমার সাথে এরকম ২য় এবং ৩য় বর্ষের ৪জন কাজ করেছে, তাদের মধ্যে ২য় ব্রিটিশ মেয়েও ছিল। কখনও কখনও সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে, সূর্যের আলোও ঠিকমত প্রবেশ করে না এমন জঙ্গলের মধ্যে এবং কোনরকম তথাকথিত টয়লেট সুবিধা ছাড়াই! সারাদিন সকাল সন্ধ্যা কাজ করার পরও একটি লোকের দেখা পাওয়া যায় না সেসব স্থানে!

আফসোস হয় এটুকু ভেবেই, আজকাল ৫০০ জনে ১ বা ২ জন পাওয়া যায় যারা কাজ শিখতে ইচ্ছুক। কিন্তু তাদের মূল্যায়ণ অনেকক্ষেত্রেই ঠিকমত হয়না। একটি ঘটনা লিখেই শেষ করি, আমি গতবছর একজনের সাথে প্রায় ৮মাস বাদুর সার্ভেতে সহায়তা করেছি যিনি আমার সুপারভাইজারের সাথে ১৫ বছর আগে পিএইচডি আর পোষ্টডক করেছেন! সারারাত আমরা দুজন মাঠে, নদীর পাশ দিয়ে বা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম বাদুরের জন্য! যাহোক, ঘটনাটি হল এই ব্যক্তিটির একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড চোখ ধাঁধানো, আমাদের লাইনের সেরা সেরা জার্নালগুলোতে অনেক পেপার, কিন্তু সে নিজে ফ্রিল্যান্স ইকোলজিষ্ট হিসেবে কাজ করে! আমি ওকে একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম আচ্ছা তুমি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা বা গবেষণায় জড়িত হবার কথা কখনও চিন্তা করনি? সে আমাকে হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিল আজকালকার ছাত্রছাত্রীরা খুবই চাহিদা প্রবণ (ডিমাণ্ডডিং)! তারা আশা করে নিজেরা কিছুই করবে না বরং শিক্ষকের কাছ থেকে সব আদায় করে নিবে বা শিক্ষক তাদের সবকিছু শিখিয়ে দিবে তাই সে এই পেশায় যুক্ত হবার কথা মাথাতেই আনে না!     

No comments:

Post a Comment