শিক্ষক হবার সুবাদে আমি বরাবরই আমার ছাত্রছাত্রীদের বই পড়তে উপদেশ এবং পরামর্শ দিয়ে থাকি যার কারণে আমার অনেক ছাত্রছাত্রী হয়তো আমাকে তেমন ‘স্টুডেন্ট ফ্রেন্ডলি’ শিক্ষক হিসেবে পছন্দ করে না। ‘স্টুডেন্ট ফ্রেন্ডলি’ শব্দটি আমার নিজের বিভাগে (ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) উৎপত্তি লাভ করলেও সঠিকভাবে মনে করতে পারছি না এই শব্দটির প্রবর্তক কে, তবে খুব সম্ভবত আমার বন্ধু ও সহপাঠী অংকুর। আমরা কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে শিক্ষকদের এই দলের অন্তর্ভুক্ত করতাম যার মধ্যে একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ‘ছাত্রছাত্রীদের নোট সরবরাহ করা’। অর্থাৎ শিক্ষক ক্লাসে তার কোর্সের নোট সরবরাহ করতেন। এটি হতে পারে খুবই ভালো একটি পদ্ধতি যেখানে বইপত্রসহ অন্য সকল সুবিধাদির অভাব রয়েছে! তবে মুদ্রার যেমন অপর পিঠ থাকে তেমনি এই পদ্ধতিরও উল্টোদিক আছে। এই ধরনের শিক্ষকদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল তারা গণহারে সবাইকে মাত্রাতিরিক্ত নম্বর দেন (জিপিএ ফাইভ টাইপ), যাতে করে তারা ছাত্রছাত্রীদের কাছে নিজের খুবই ভাল ইমেজ ধরে রাখতে পারেন। অবশ্য অনেক শিক্ষকও সারাবছর ক্লাস না নিয়ে কিন্তু পরীক্ষায় ঢেলে নম্বর দিয়ে এই ইমেজ ধরে রাখেন এবং নিজের ফাঁকিবাজি হালাল করেন। এতে করে কি প্রকৃত মেধাবীদের অবমূল্যায়ন করা হয় না? যাই হোক, এগুলো তিতা কথা... ভাল লাগবে না।
বিভিন্ন সময়ে ক্লাসে আমি ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি। বেশিরভাগই বেসিক প্রশ্ন এবং ছাত্রছাত্রীদের উত্তরের পর আমি যদি তাদের কাছে সেই উত্তরের উৎস (রেফারেন্স) জানতে চাইলেই তারা চুপ বা কোন একজন শিক্ষকের নাম বলেছে। খুব কম ক্ষেত্রেই বই এর মত কোন প্রতিষ্ঠিত গ্রহণযোগ্য উৎসের নাম তারা বলেছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমরা যখন প্রথম বর্ষে ভর্তি হই তখন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়াম মার্কেটের ফটোকপির দোকানে ভিড় লেগে থাকতো বই-এর জন্য। মানছি যে বই ফটোকপি করা কপিরাইট আইনের সম্পূর্ণ বিপক্ষে কিন্তু আমাদের মতো দেশে বিদেশী বইয়ের আসল কপি কিনে পড়ার সক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা সৌভাগ্যবান ছিলাম যে আমাদের সময় বেশীর ভাগ শিক্ষক আমাদের নোট সরবরাহ করে ‘স্টুডেন্ট ফ্রেন্ডলি’ হওয়ার চেষ্টা করেননি। তারা কখনও ছাত্রছাত্রীদের মেধাকে সীমাবদ্ধ করার জন্য নোট সরবরাহ করেননি। বিপক্ষে যুক্তি আসতে পারে যে সরবরাহকৃত নোট পড়ার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের অন্য বই পড়ার প্রতিও তো উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হল আমাদের ছাত্রছাত্রীরা কি সেটি করে? বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সেটি করে না বরং বেশীরভাগ ছাত্রছাত্রীই এই নোট সরবরাহ করাকে পছন্দ করে। কারণ তারা শুধু মুখস্থ করেই পরীক্ষায় সেটি গড়গড় করে লিখে যাচ্ছে এবং খুবই ভালো গ্রেডসহ পাশ করে যাচ্ছে। তারা তাদের ছাত্র জীবনে এটি অনুধাবনই করতে পারে না যে ভালো গ্রেড নিয়ে পাশ করলেও ভবিষ্যতে তাদের নানা অসুবিধার সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে আমার মতো যারা উন্নত দেশে উচ্চতর ডিগ্রী নিতে আসবে বা দেশে বসেই ভালো কোন সুপারভাইজারের অধীনে গবেষণা করবে। কারণ সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে প্রচুর পড়াশুনার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হল আপনাকে আপনার সুপারভাইজার কোন নোট সরবরাহ করবেন না! নির্ভর করতে হবে বই এবং গবেষণা প্রবন্ধের মতো প্রতিষ্ঠিত উৎসগুলির উপর। এখানে সরবরাহকৃত নোট হতে লব্ধ জ্ঞান কাউকে খুব বেশী সাহায্য করবে বলে মনে হয় না। সুতরাং বইপত্রের সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব যত বেশীদিনের হবে ততই লাভ হবে। অনেকে বলবে কেন যারা নোট পড়ে বাইরে যাচ্ছে তারা কি ডিগ্রী না করেই ফিরে যাচ্ছে? কথা হল তারা হয়তো ফিরে যাচ্ছে না কিন্তু তাদের উপর যে চাপটি পড়বে সেটি সামলানো খুব সহজ নয় এবং যার কারণে হয়তো অনেকের মুখেই শোনা যায় বাইরে ডিগ্রী করা খুব কঠিন। মানছি যে দেশের বাইরে ডিগ্রী করা কঠিন... কিন্তু কারণ কি? কারণ হল এখানে ফাঁকি দেবার সুযোগ নেই, কিংবা মুখস্থ করে ভালো করারও সুযোগও কম যেটি আমাদের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হয়ে আসছে। ভাগ্যিস কিছু বইপত্রের সাথে সম্পর্ক ছিলো বলেই এখন পর্যন্ত এধরনের কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। অনেকেই বলবে বাইরে পিএইচডি করবে, প্রথমে এমএস করতে হবে তা না হলে পিএইচডি করা খুব কঠিন হবে। আমি বলবো এই যুক্তি কোন যুক্তিই না যদি পর্যাপ্ত সংস্পর্শ থাকে বইপত্রের সাথে।
এছাড়া একটি সহজ প্রশ্নের উত্তর দিন তো, নোট তৈরি করে ছাত্রছাত্রীদের সরবরাহ করা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ? আমরা দিন দিন পড়াশুনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি! এতে করে যে একজন ছাত্রের নিজস্ব প্রতিভার বিকাশ, চিন্তাভাবনা, দক্ষতা, স্বনির্ভরতা এবং সর্বোপরি জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করে তাদেরকে তাদের অজান্তেই অনেকটা পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে এবং সেটি তারা বুঝতেও পারছে না। আমার নিজের ফিশারীজ বিভাগ ইতোমধ্যে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের কাছে থেকে ফিডব্যাক পাওয়া শুরু করেছে, তবে অদূর ভবিষ্যতেও `জিপিএ৫` এরও সুফল পাওয়া শুরু করবে বলেই আমার বিশ্বাস!
(সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে লেখা, যদিও বিশেষ ক্ষেত্রে নিজের বিভাগের উদাহরণ ব্যবহার করেছি)
No comments:
Post a Comment