প্রাচ্যের স্কটল্যাণ্ড: শিলং

শিলং শহরের একাংশ
বলতে পারেন ভারতের কোন কোন স্থান ভ্রমণের জন্য বিখ্যাত? সবার আগে বেশীরভাগ লোক যার কথা বলবে সেটি হল দার্জেলিং। তবে অনেকেরই হয়ত ধারনা নেই যে আরও একটি স্থান ভারতে আছে যেটি হল শিলং, যার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে ‘দার্জেলিং যদি রানী হয় তবে শিলং হল রাজা’! আসামের গৌহাটী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন অনলাইন বন্ধু আমাকে আগেই জানিয়েছিল যে তুমি যদি প্রকৃতি পছন্দ কর তবে উত্তরপূর্ব ভারত এবং যদি ইতিহাস পছন্দ কর তবে দিল্লী ঘুরে যেও। আগে থেকেই আমার ভারতের এই অংশটির প্রতি দুর্বলতা ছিল তারপর আবার এই কথা শুনে সেটি আরও বেড়ে গিয়েছিল। ত্রিপুরাতে যখন আমন্ত্রণ পেলাম তখনই ঠিক করে ফেলেছিলাম যে এইবারই মেঘালয় এবং আসামও ঘুরে যাব। শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু আখতার স্যারের সুবাদেই এই ভ্রমণের সুযোগ, তাকে আমার পরিকল্পনা জানাতেই তিনি বললেন কোথায় কোথায় ঘুরতে হবে এটি তুমি ঠিক কর! এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!

আমাদের ভ্রমণ টীমের সকলে...
১১ এপ্রিল (২০১৬) সকালে একটি স্করপিওতে করে আমাদের যাত্রা শুরু হলো ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা হতে। গন্তব্য মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলং যার দূরত্ব ৪৫০ কিমি এর অধিক। ত্রিপুরার রাস্তাঘাট খুবই ভাল কিন্তু মধ্যপথে আসাম রাজ্যের কিছু অংশে পড়বে সেখানেই যত সমস্যা... আমাদের গাড়ি আগরতলা হতে বের হতেই শুরু হল পাহাড়ী রাস্তা, দু’পাশে বন- অসাধারণ দৃশ্য। এরপর আসামের সীমানায় প্রবেশ করলাম যেখানে নামে হায়ওয়ে কিন্তু বাস্তবে আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের বর্ষাকালে মাটির রাস্তার যে অবস্থা হয় অনেকটা সেটি! আমাদের গাড়ির গতি ঘন্টায় ৫–৮ কিমি হয়ে গেল কোন কোন অংশে। তবে পথিমধ্যে রাস্তার পাশের চা বাগান ও রাবার বাগান ভাল লাগবে। পথিমধ্যে আসামের করিমগঞ্জ যেটি একটি মুসলমান অধ্যুষিত জেলা এবং এখানেই একটি মনে রাখার মত বিষয় লক্ষ্য করলাম, সেটি হল অনেক ট্রাকের পিছনে লেখা ‘আপনার সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠান’! আমাদের দেশে সাধারণত বলা হয়ে থাকে সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে সেখানে একটি হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্রে এরকম লেখা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না!

অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে আমরা যখন মেঘালয়ের সীমানায় প্রবেশ করলাম তখন দিনের আলো ফুরিয়ে গেছে। মেঘালয়ে প্রবেশের সাথে সাথেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি, যেন আমাদের বরণ করে নেয়া হল এই রাজ্যের চিরাচরিত আবহাওয়া দিয়ে। একে তো অন্ধকার পাহাড়ী সরু রাস্তা তারপর আবার এই বৃষ্টি এবং বজ্রপাত, গাড়িতে বসে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা ছাড়া কোন বিকল্পই ছিল না। বৃষ্টি থামল কিছুক্ষন পর এবং এরপরই যা দেখলাম তাতে সারাদিনের ক্লান্তি এবং একটু আগের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা ভুলে গিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকলাম রাস্তার দু’পাশে... এখানে একটু জানিয়ে রাখা ভাল যে মেঘালয় রাজ্য প্রধানত খাসিয়া জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা এবং এদের পরিবারের প্রধান হল মহিলা। ত্রিপুরাতে থাকা অবস্থায়ই শুনেছিলাম এই কথা এখন বাস্তবে দেখছিলাম। রাত তখন প্রায় ১১ পার হয়ে গেছে, রাস্তার দুপাশের দোকানগুলো তখনও খোলা এবং প্রতিটি দোকানে মহিলারা বসে আছে(!) ঠিক যেমন আমাদের দেশে পুরুষরা থাকে। আর লাইটের আলোয় রাস্তার দু’পাশে বাড়িঘরের যতটুকু দেখা যাচ্ছিল তা ছবির মতই! এভাবে দেখতে দেখতেই শিলং শহরের কাছাকাছি পৌঁছালাম, রাত তখন ২.৩০! আরও একটি কথা... শিলং এমনিতেই খুবই সুন্দর কিন্তু রাতের শিলং এর তুলনা পাওয়া ভার! শিলং-এর চারপাশেই পাহাড় এবং শহরটি পাহাড়ের গোড়ায় যার কারনে শহরে ঢুকতে হলে পাহাড় থেকে নামতে হবে নীচের দিকে! এই কারনেই আপনি যদি রাতের বেলা সেখানে যান তবে সমগ্র শহরটি আপনি একনজরে দেখতে পাবেন... বাড়িঘরের লাইটগুলো দেখে মনে হবে লক্ষ লক্ষ জোনাকি পোকায় যেন এলাকাটি ছেয়ে গেছে! সে এক অসাধারণ দৃশ্য!

চেরাপুঞ্জীর পথে...
মূল শহরে প্রবেশ করার পর আমাদের নির্ধারিত হোটেল এর সামনে যেয়ে যা বুঝলাম তাতে আমাদের আক্কেল গুড়ুম। আমাদের পৌঁছাবার কথা ছিল রাত ১০টার আশেপাশে কিন্তু এখন রাত প্রায় ৩টা! হোটেল এর প্রধান দরজা বন্ধ! অনেক ডাকাডাকি করেও লাভ হলনা, কেউ নেই। অবশেষে পাশের একটি হোটেলে ঠাঁয় মিলল রাতটুকুর জন্য! পরের দিন (১২ এপ্রিল) সকালে নাস্তা করেই বের হয়ে গেলাম, গন্তব্য বেশকিছু স্থান... যারমধ্যে অন্যতম চেরাপুঞ্জি! যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী বৃষ্টিপাত হয়- এটি আমরা সবাই ছোটবেলা হতেই বইয়ে পড়ে এসেছি। যাহোক শিলং সম্পর্কে একটু না বললেই নয়...পূর্বেই বলেছি শিলং ভারতের পাহাড়ী রাজ্য মেঘালয়ের রাজধানী। তবে এটুকু বললেই শিলং-এর পরিচয় পূর্ণতা পাবে না! শিলং শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ১৫০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত তবে শিলং এর সর্বোচ্চ উঁচু স্থানটি হল ‘শিলং পিক’ যার উচ্চতা ১৯৬৬ মিটার! ব্রিটিশদের হাতে ১৮৬৪ সাল হতে শিলং শহরটির ব্যাপ্তী শুরু হয়। ১৯৭২ সালে পৃথক মেঘালয় রাজ্য তৈরীর পূর্বে শিলং আসামের রাজধানী ছিল। অপেক্ষকৃত শীতল আবহাওয়ার (চির বসন্ত) জন্য অবকাশ যাপনের স্থান হিসেবে ইংরেজদের কাছে একটি খুবই জনপ্রিয় ছিল। শুধু ইংরেজরা নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেকেই গ্রীষ্মকালীন সময়ে এখানে পাড়ি জমাতেন।

এলিফ্যান্ট ফলস...
ফিরে আসি আমার কাহিনীতে... আপাতত আমাদের গন্তব্য ‘এলিফ্যান্ট ফলস’, মূল শহর হতে ১২ কিমি দূরে। ছোটবেলা থেকে দোকানে খাতা কিনতে গিয়ে দেখতাম মলাটে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি যার মধ্যে একটি ঝর্ণার ছবি থাকত- সেটিই এই এলিফ্যান্ট ফলস! এখানে নাকি হাতির শূরের আকৃতির একটি পাথর ছিল যার কারণে ইংরেজরা এই ঝর্ণার নাম দেয় এলিফ্যান্ট ফলস। এখানে কিছু দোকানপাটও আছে চাইলেই কিনে নিতে পারেন কিছু স্যুভেনির। আমার বরাবরই এসব জিনিসের প্রতি লোভ মাত্রাতিরিক্ত সুতরাং কিনে ফেললাম স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চিহ্নবহনকারী কিছু জিনিসপত্র! এরপর পুনরায় যাত্রা শুরু, এবারের গন্তব্য চেরাপুঞ্জী। মেঘালয়ে রাস্তা খুবই ভাল এবং সেই সাথে চারিদিকের যেদিকেই তাকান যায় অসাধারণ দৃশ্যপট! রাস্তার দু’পাশে পাথুরে পাহাড় যার অনেকগুলো হতে পাথর সগ্রহ করা হচ্ছিল। রাস্তার দু’ধারের বাড়ি ঘর ছবির মত- অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের (কারণ হয়ত খাসিয়ারা তুলনামূলকভাবে ছোটখাটো সাইজের হয়...) এবং বিভিন্ন বর্ণে বর্ণিল! মনেই হচ্ছিল না যে আমরা ভারতে আছি... ইংরেজদের প্রভাব সুস্পষ্ট!

ডায়েনথলেন ঝর্ণা...
চেরাপুঞ্জীতে দেখার অনেকগুলো জায়গা আছে... এর মধ্যে Wah Kaba Falls, Dainthlen Falls, Nohkalikai Falls, Nohsngithiang Falls, Mawsmai Cave, Thangkharang Park, Khoh Rahha অন্যতম । সংগত কারনেই ইংরেজী বানান লিখলাম... আমাদের হাতে সময় খুবই অল্প, কারন আজই আমরা আসামের গৌহাটী যাব... আমরা যখন চেরাপুঞ্জি পৌঁছেছিলাম তখন ১২টা পার হয়ে গিয়েছিল সুতরাং যাকে বলে দৌঁড়ের উপর সবকিছু দেখলাম... ঝর্ণাসমূহ অসাধারণ, তবে আসল সৌন্দর্য্য দেখতে হলে যেতে হবে বর্ষার সময়। আর মাওস্বামী গুহাটি এককথায় অসাধারণ, তবে যাদের হার্টের সমস্যা আছে তাদের প্রবেশ না করাই ভাল। এছাড়া যাদের বদ্ধ জায়গায় দম বন্ধ হয়ে আসে তারা অবশ্যই প্রবেশ করবেন না। গুহাটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল ছাদ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঠাণ্ডা পানি পড়ে!

বড়াপানি অথবা উমিয়াম লেক
দুপুরে খাবার খেলাম গুহার কাছেই একটি হোটেলে... রান্না খুব ভাল। এরপর রওনা দিলাম গৌহাটী। শিলং হতে গৌহাটীর রাস্তায়ই পড়বে বিখ্যাত উমিয়াম লেক (স্থানীয়ভাবে ‘বড়াপানি’ নামে পরিচিত; শিলং হতে প্রায় ১৫ কিমি উত্তরে)। আমাদের কাপ্তাই লেকের মত উমিয়াম নদীতে বাঁধ দিয়ে এই হ্রদটি কৃত্রিম ভাবে তৈরী করা হয় ১৯৬০ দশকের শুরুতে। বিশাল এই লেকটি মুগ্ধ করার মতই। পড়ন্ত বিকেলে হ্রদটি আরও সুন্দর লাগছিল... কিন্তু আমাদের যেতে হবে আরও অনেক দূর... সুতরাং...

বিশেষ দ্রষ্টব্য
শিলং এমনিতেই সুন্দর কিন্তু বর্ষাকালে আরও...
রাতের শিলং অবশ্যই দেখবেন...
সম্ভব হলে চেরাপুঞ্জিতে একরাত থাকবেন...
হোটেল আগেভাগেই বুকিং দিয়ে রাখবেন, তৎক্ষনাৎ ভাল হোটেন নাও পাওয়া যেতে পারে...
রাত করে শিলং না পৌঁছানোই ভাল... হোটেল খোলা নাও থাকতে পারে (বুকিং দেবার পরও)...
শিলং এবং চেরাপুঞ্জির অনেক আকর্ষণীয় স্থানে প্রবেশের জন্য টিকিট ক্রয় করতে হবে...

3 comments: