রোড টু ডারহাম, ০২: স্বপ্নের বাস্তবতা?

নিজ বিভাগ হতে সাময়িক বিদায়!
ফিশারীজে ভর্তি হবার পর থেকেই নাম শুনে এসেছি এআইটি (এশিয়ান ইস্টিটিউট অব টেকনোলজী, ব্যাংকক) এবং স্টারলিং (স্কটল্যাণ্ড, যুক্তরাজ্য) এর। শ্রদ্ধেয় আখতার স্যারের কল্যানেই ছাত্রজীবনে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম জেনেছিলাম এবং পরবর্তীতে নিজেরও সরাসরি দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রভাব। সমগ্র ছাত্রজীবনেই স্বপ্ন ছিল এআইটিতে মাস্টার্স এবং স্টারলিং-এ পিএইচডি করার! আমার বরাবরই কেন যেন যেসব দেশের প্রথম ভাষা ইংরেজী না সে দেশগুলোর প্রতি তেমন একটা টান ছিল না! কারন সম্ভবত দুটি- (১) নতুন একটি ভাষা শিখতে হবে ভাল মত টিকে থাকার জন্য! আমার ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটি প্রযোজ্য সেটি হলো ‘বাংলাই ভাল মত জানি না আবার নতুন একটি ভাষা! আমার দ্বারা হবে না!’ এবং (২) এসকল দেশে নাকি কাজের প্রচুর চাপ, সেই সকালে ল্যাবে ঢুকতে হয় এবং ল্যাব থেকে বেরতে রাত হয়ে যায়! সুতরাং আমার মত ফাঁকিবাজ কখনই এই পরিবেশে টিকতে পারবে না যেখানে নিয়মিত রুটিনের মধ্যে থাকতে হবে! কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সমস্যার এখানেই তো শেষ নয়! বিদ্যুৎ বেগে মাত্র সাড়ে আট বছরের বেশী সময়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার পর যখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে স্বপ্ন পূরণের! যদিও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগটিকে আমরা সেশনজটের আখড়া বলে জানি, তবে আমাদের বিভাগও কম যায় না দেখছি! যাহোক এখন যদি দেশের বাইরে মাস্টার্সের জন্য চেষ্টা করি তাহলে সব মিলিয়ে আরো ৩ বছর! সুতরাং আপাতত বাইরের চিন্তা বাদ দিয়ে শুরু হলো বেকারত্ব ঘুচানোর সংগ্রাম।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিটা হয়ে গেল হঠাৎ করেই। যদিও প্রায় বছর খানেক পরেই সেখানের স্থায়ী চাকরিটি ছেড়ে চলে এলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, এডহক ভিত্তিতে! অনেকের কাছেই পাগল উপাধি পেয়েছিলাম এই কারনে! দুই বছর চরম মানসিক নিপিড়নের পর যখন চাকরি স্থায়ী হলো তখন আমার দেশের বাইরে মাস্টার্সের স্বপ্নতো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়ে গেছেই উপরন্ত পিএইচডি এর সম্ভবনাও নিভু নিভু। সেসময় আমার অবস্থাটি হলো ‘যেখানে স্কলারশীপ পাবো সেখানেই চলে যাব, টাকা পয়সা না দিলেও হবে... কোন রকমে থাকা খাওয়ার খরচ দিলেই হবে!’ আমার অবস্থা যখন এই তখনও আশেপাশের দু-একজনের তাদের ক্যারিয়ারের প্রতি মনের দৃঢ়তা ও পরবর্তীতে সাফল্য দেখে বোধহয় নিজের অর্ধমৃত টার্গেট পুনরায় পুনর্জীবিত হল! ঠিক এরকম একটি সময়েই হঠাৎ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমনওয়েলথ স্কলারশীপের প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়ে যাওয়ার প্রায় ফিকে হয়ে যাওয়া স্বপ্নের বাতি জ্বলে উঠার একটি সম্ভবনা তৈরী হল।

নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসিতে পরবর্তী ধাপের জন্য লড়াই করবে বাংলাদেশের অন্যন্য বিশ্ববিদ্যালয় হতে আমার মত প্রাথমিক মনোনায়ন পাওয়া অনেকেই। নিজেকে প্রস্তুতির প্রাথমিক পর্ব হিসেবে শুরু হলো প্রফেসর ম্যানেজ করার প্রচেষ্টা। গত কবছরে আমি আমার গবেষণার ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করে ফেলেছি যা আমার স্বপ্নের স্টারলিং এর বিষয়গুলোর সাথে সাংঘর্ষিক এবং এ কারনে স্টারলিং-এ আমার পিএইচডির আবেদনই করা হলো না। যাহোক বেশী কষ্ট করতে হয় নি! ডারহাম থেকে আমার বর্তমান সুপারভাইজার প্রায় ১০০০+ শব্দের একটি খুবই সংক্ষিপ্ত পজিটিভ রিপ্লাই দিলেন তাকে ইমেইল পাঠানোর পরদিন (! এখন যখন মুখোমুখি রুমে অফিস হওয়া সত্ত্বেও দেখি সে ১০০০+ শব্দের ইমেইল নিয়মিত পাঠাচ্ছে তখন অনুধাবন করি তার জন্য এটিই স্বভাবিক!)।

অবশেষে সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে ইউজিসি ভবনে দেশের সকল প্রান্ত থেকে আসা পরবর্তী ধাপের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা একত্রিত হলাম। আমার জ্ঞানের পরিধি এতই বিস্তৃত ছিল যে আমি জানতামই না সঠিক কতজন পরবর্তী ধাপের জন্য আজ নির্বাচিত হবে! তবে একুটু জেনে গিয়েছিলাম যে মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে কাগজপত্রেই ৮০ এবং বাকী ২০ মার্কস-এর জন্য আজ আমাদের সকলের আগমন। এখানে আসার পরই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনের কাছে জানতে পারলাম মাত্র ১০ জনকে পরবর্তী ধাপের জন্য নির্বাচন করা হবে! বলে কি! এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাত্র ১০ জন! যাহোক এরপর কি হলো বিস্তারিত লিখতে গেলে অনেক কিছুই লেখা হয়ে যাবে এবং তাতে অনেকেই ইউজিসির সিলেকশনের চৌদ্দগোষ্ঠীও উদ্ধার করে দেবেন (সত্যি কথা বলতে কি আমিও এইরকম ধারণা পোষন করতাম এবং এই কারনেই কখনও কমনওয়েলথ এ আবেদনের কথা চিন্তাই করিনি!)। তবে শুধু এটুকু বলছি যে ১০ জনের তালিকায় আমার নাম ছিল এবং ভাইভা বোর্ডে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সদস্য ছিলেন না (ঐ সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ ইউজিসি সদস্যও ছিলেন না)।

অবশেষে কমনওয়েলথ-এ আবেদনের যোগ্যতা লাভ করলাম! এখানে একটি কথা জেনে রাখা ভাল যে ‘কমনওয়েলথ স্কালারশীপের জন্য ইউজিসির নির্বাচনই চূড়ান্ত নির্বাচন’ কথাটি খুবই অসত্য! আমি আমার অনেক সহকর্মীকেও দেখেছি (এমনকি যারা দেশের বাইরে পিএইচডি করছেন তাদের অনেকেই) যারা এই ভুল ধারনা নিয়ে বসে আছেন! চরম সত্যিটি হলো ইউজিসির সিলেকশনের পর আপনি কমনওয়েলথ-এ আবেদনের যোগ্যতা লাভ করবেন! কিন্তু এই কথাটিই আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারছিলাম না! প্রায় সবাই দেখা হলেই একটি কথা ‘যাওয়া কবে?’। আর একটি সত্য হলো কোন দেশের জন্যই কমনওয়েলথ এর কোন কোটা নেই শুধুমাত্র জেন্ডার-সমতা নিয়মটি আছে। তাছাড়া আমি কয়েকজনের কথা জানি যারা ইউজিসির সিলেকশন পাবার পরও পরবর্তী ধাপ পার করতে ব্যর্থ হয়েছে! সুতরাং যে যাই বলুক আমার অবস্থা তখন আরো খারাপ এই ভেবে যে এতদুর আসার পর যদি না হয় কেমন লাগবে... তার চেয়েও বড় কথা এই লোকগুলো কি বলবে! যদিও কারো কথায় আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই...

যাহোক, কমনওয়েলথ স্কলারশীপের জন্য আবেদন যে এত ঝামেলার তা আমার ধারনার বাইরে ছিল। আবেদনে আমি যুক্তরাজ্যের ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দ করতে পারবো (যদিও ভর্তির ব্যাপারে কমনওয়েলথ কোন সাহায্য করবে না, আপনাকেই করতে হবে নিজ যোগ্যতায়! আপনি স্কলারশীপ পাবার পর যদি নিজ যোগ্যতায় ভর্তি না হতে পারেন তাহলে স্কলারশীপ বাতিল!) এবং সেই সাথে ৩জন সম্ভবনাময় সুপারভাইজার এর নামও প্রস্তাব করতে হবে। এক্ষেত্রেই আমি করলাম স্মরণীয় দুঃসাহসিক কাজটি! আমি শুধুমাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একজন সুপারভাইজারের নাম লিখে আবেদন সাবমিট করে দিলাম নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে (১৯ তারিখ ডেডলাইন ছিল)! পরে একথা যে শুনেছে সেই আমাকে মোটামুটি একহাত নিয়ে নিয়েছে (তাদের ভাষায়, এমন রিস্ক নেবার জন্য! যদি কোন কারনে এখানে সম্ভব না হয়!)। আমি মোটামুটি নিরুত্তাপ... আবেদনে বিবেচনা করা হবে বেশ কটি বিষয়... প্রধানত- (১) আমার প্রস্তাবিত গবেষণা কর্মের মান, (২) এই গবেষণার সাথে আমার দেশের উন্নয়নের সম্পর্ক, এবং (৩)  আমার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউণ্ড। এজন্য আমাকে আবদনপত্রে কয়েকশ শব্দের একাধিক রচনাও (!) লিখতে হয়েছে!  আর একটি ব্যাপার না বললেই নয়, আমাকে প্রায় সবাই বলে তুমি কেন ক্যামব্রিজ বা অক্সফোর্ড চয়েস দাও নি? আমি শুধু এটুকু বলি যে দেখেন আমি আসলে চেষ্টাও করিনি... কারন আমার গবেষনার সাথে মিল রেখে আমি সেখানে কোন পছন্দের সুপারভাইজারই পাইনি! এখানে উল্লেখ্য যে ঐ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সকল যোগ্যতাই (ইংরেজীর স্কোর, পড়াশুনার রেজাল্ট ইত্যাদি ইত্যাদি) আমার ভালমতই ছিল। তাছাড়া ডারহাম খারাপ কোন দিক দিয়ে? আপনারা একটু চোখকান খোলা রাখলেই বুঝতে পারবেন... আসল কথা আমার সুপারভাইজার, এরকম মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার!

যাহোক অতঃপর অপেক্ষা... প্রতিদিনই একাধিকবার ওয়েবসাইটে ঢু মেরে দেখি যে কোন আপডেট আছে কি না... ইতোমধ্যে কমনওয়েলথ-এর ওয়েবসাইট হতে জানতে পেরেছি এপ্রিলে রেজাল্ট হবে! এরমধ্যে মাঝেমাঝেই আশেপাশ থেকে উড়োখবর... একদিনতো এক সহকর্মী বিভাগের বারান্দায় দেখা হতেই জানতে চাইলেন ‘কমনওয়েলথের তো রেজাল্ট হয়ে গেছে... তোমার কি খবর? অমুকের তো হয়ে গেছে... অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে... জাপানী এক্সপার্ট ছিল যে তার আবেদন মূল্যায়ন করেছে!’ আমি থতমত খেয়ে জানালাম যে আমি তো এরকম কিছুই জানি না! রেজাল্টতো এপ্রিলে হবার কথা। তিনি জানালেন তোমার তাইলে হয় নি মনে হয়... রেজাল্ট হয়ে গেছে তুমি জানো না... বাড়ি এসে আবারও ওয়েবসাইট চেক করলাম... নাহ এপ্রিলই তো লেখা! পরিচিত কাউকেই চিনি না যে একটু শুনে নিশ্চিত হবো ব্যাপারটি আসলে কি! এরকম একটা মানসিক অশান্তির মধ্যে দিন পর করতে করতে হঠাৎই একদিন (জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ মনে হয়) ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে ইমেইল... কমনওয়েলথ স্কলারশীপের আবেদনের অংশ হিসেবে আইএলটিএস দিতে হবে! আবার এই জঘন্য অভিজ্ঞতা লাভ করতে হবে! তাছাড়া আমি আইএলটিএস দিয়েছে গত জুনে এবং এর দুবছর মেয়াদের মধ্যে একবছরও পার হয়নি! তাছাড়া আমার স্কোরও কমনওয়েলথ এর কাঙ্খিত স্কোর (নূন্যতম ৬.৫) হতে বেশী! কিন্তু কমনওয়েলথের পলিসি বলে কথা... অক্টোবর ২০১৫ হতে মার্চ ২০১৬ এর মধ্যেই আইএলটিএস পরীক্ষা দিতে হবে এবং এই স্কোরটিই বিবেচ্য হবে এবং সেখানে যদি ৬.৫ এর নিচে কেউ পেলে সে আউট, আগে তার স্কোর ৯.০ থাকলেও হবে না! আজিব নিয়ম! যাহোক অতকিছুর মধ্যে এটুকু সান্তনা এই যে এই পরীক্ষাটি ফ্রি ফ্রি দেয়া যাবে! মানে সব খরচই কমনওয়েলথ বহন করবে! তার থেকেও শান্তির কথা হলো যে আমি এখনও আউট হয়ে যাই নি!... ঢাকায় আইএলটিএস পরীক্ষাটি দিয়েছিলাম বোধহয় জানুয়ারীর (২০১৬) শেষ দিকে।

এরপর আবারও শুরু হলো অপেক্ষার পালা... এপ্রিলে কোন সময় রেজাল্ট হবে তাও জানি না... দেখতে দেখতে এপ্রিল চলে এলো... ৪ তারিখ রাতে পেলাম স্বপ্নের সেই ইমেইলটি, কমনওয়েলথ এর সেক্রেটারীর কাছে থেকে... অভিনন্দন জানিয়েছেন কমনওয়েলথ স্কলারশীপের জন্য প্রাথমিক সিলেকশন পাবার জন্য! আমি তখন আমার স্টাডিতে... একা... কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না... মাথা কেমন যেন ভোতা হয়ে গেছে!

ইতোমধ্যে আমি ডারহামের এ্যাডমিশন অফার লেটার পেয়ে গেছি সুতরাং আর তেমন কোন ঝামেলাও নেই। জুন/জুলাই মাসের মাঝামাঝি হাতে পেলাম (ডাকযোগে) চূড়ান্ত সিলেকশন লেটার। এরপর ভিসার জন্য আবেদন... সেটিও হয়ে গেল... অবশেষে সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখে বিলাতে যাত্রার দিন ঠিক হলো... 

No comments:

Post a Comment