শীতবস্ত্র কাব্য ০১

গতরাতেও বিছানায় যেতে প্রায় ৩টা বেজে গিয়েছিলো, শঙ্কায় ছিলাম যে সকালে সময়মত ঘুম থেকে উঠতে পারবো কিনা। তিনটি এ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু ৬টার দিকেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো! আজ আমাদের রোটারী ক্লাব অব পদ্মা রাজশাহীর এবারের শীতের প্রথম শীতবস্ত্র বিতরণ ও মেডিকেল ক্যাম্প করার নির্ধারিত দিন। গত শনিবারেও আর একটি ভেন্যুতে করার কথা থাকলেও অবরোধের কারনে আমরা স্পটে পৌঁছেও তা বাতিল করে দিতে বাধ্য হয়েছি। পরবর্তীতে আবার ঐ স্থানে যাওয়া হবে। গত দু-একদিন রাজশাহীতে আবহাওয়া এমনই প্রতিকূল ছিলো যে আমরা সবাই বেশ আশঙ্কায় ছিলাম যে আজ সকালেও কুয়াশা যদি একইরকম থাকে তবে আমাদের কর্মসূচীতে নিশ্চিত বিলম্ব ঘটবে কয়েক ঘন্টা। যাহোক কুয়াশা আজও ছিলো কিন্তু সেটি রাস্তায় গাড়ি চালানোর জন্য তেমন সমস্যার মনে হলো না। আজ আমাদের গন্তব্য বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রত্যন্ত ৩টি সাঁওতাল আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম যারা স্বভাবিক জীবনযাপনের মোটামুটি বেশীরভাগ সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত।


ঘুম থেকে উঠে চোখ বন্ধ করেই একরকম কাঁপতে কাঁপতে চোখমুখে পানি দিয়ে কোনরকম শীতবস্ত্র গায়ে চাপিয়েই বাসা হতে বের হলাম। বাসার নীচে নামতেই বুঝতে পারলাম শীতের প্রকোপ! কোনরকম গাড়িতে উঠেই হিটার! চারদিকে কুয়াশার চাদরের মধ্যেই শুরু হলো আমাদের যাত্রা। আমাদের সাথে প্রবীণ রোটারিয়ান প্রফেসর ড. শামসুল আলম স্যার ছিলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য অনিয়মিত ভূমির উচ্চতার (যাকে আমরা বলে থাকি ল্যাণ্ড টপোগ্রাফি) ফসলের ক্ষেতের বুকচিরে চলমান রাস্তা ধরে যাওয়ার একপর্যায়ে উঠে এলো ফসলের ক্ষেতের বিশাল আকৃতির ইদুরের গল্প। স্যার তার আফ্রিকায় ৮ বছর থাকাকালীন সময়ের ইদুর সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে শেয়ার করলেন। তিনি ছিলেন নাইজেরিয়ায়, সেখানে তিনি দেখেছেন নাইজেরিয়ানরা কিভাবে ইদুর ধরে ধরে রান্না করে বাড়িতে বা পাব-এ (স্থানীয় হোটেল, রাস্তার ধারে অবস্থিত) উপাদেয় খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। ইদুর, খরগোশ ও অন্যান্য বণ্য প্রাণী হতে প্রস্তুতকৃত এই জনপ্রিয় (!) খাবারটি “বুশমিট” নামে পরিচিত। প্রসঙ্গক্রমে উঠে এলো ধূমায়িত বাদুর (স্মোকড ব্যাট) খাবারের কথাও! এসব কথা শোনার পর আমাদের আমাদের আরেক রোটারিয়ান সারা ইসলামের তো অবস্থা খারাপ। এরপর স্যার আর একটি মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন সেখানকার সামাজিক প্রথা সম্পর্কে। তিনি একদিন তার প্রতিবেশী এক মহিলাকে আনন্দের সাথে নাচানাচি করতে দেখলেন উচ্চস্বরে মিউজিকের সাথে সাথে । তিনি তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে এমন কি খুশির ব্যাপার হয়েছে যে তুমি নাচছো? উল্লেখ্য যে সেখানে খুশির কোন কিছু হলেই সবাই প্রকাশ্যে নাচানাচি করতে লেগে যায়! জবাবে সেই মহিলা তাকে জানালো যে তার স্বামী আজ আর একটি বিয়ে করতে যাচ্ছে!!! জবাব শুনে তো স্যারের আক্কেল গুড়ুম। তিনি সাথে সাথে সেখান থেকে সরে এসে অন্য এক ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলেন যে এই মহিলার স্বামী আর একটি বিয়ে করতে যাচ্ছে আর সে আনন্দে নাচানাচি করছে ব্যাপারটি কেমন নয় কি? জবাবে ব্যক্তিটি তাকে বললেন কেন? এটি তো ঐ মহিলার জন্য খুবই খুশির খবর কারন সে আজ সিনিয়র ওয়াইফ হতে যাচ্ছে! আজ থেকে সে তার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী (জুনিয়র ওয়াইফ) এর উপরে খবরদারি করতে পারবে, এতে তার উপরে পরিবারের কাজের চাপ থেকে শুরু করে সবকিছুর চাপই কমে যাবে!
যাহোক প্রায় দেড় ঘন্টা বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামীণ পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাত্রা শেষ করে আমরা পাকা রাস্তা হতে একটি মাটির কাঁচা রাস্তায় নামলাম গাড়ি নিয়ে। এবার হলো বিরম্বনা, কারন মাটির এমন উচু-নিচু রাস্তায় প্রায়ই আমাদের কারের তলা মাটিতে ঘষা খাচ্ছিলো। অবশেষে আমরা আমাদের কাঙ্খিত গ্রামে পৌঁছলাম। সেখানে আগে থেকেই স্থানীয় গ্রামবাসীরা জড়ো হয়ে ছিলো।

আমাদের রোটারী ক্লাবের ৩ জন ডাক্তার আমাদের সাথে ছিলেন। তারা ৩টি স্থানে বসে গেলেন মেডিকেল ক্যাম্প করার উদ্দেশ্যে। আরও ৩ জন রোটারিয়ান তাদের সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হলেন। ৩ জন ডাক্তার রোগী দেখার পর প্রেসক্রিপশন দিতে থাকলেন এবং একটি পৃথক স্থানে আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়া ঔষধপত্র থেকে তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রোগীদের ঔষধ দেয়া হলো। এভাবে প্রায় ৩টি গ্রামের ১৫০ জন রোগীকে চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ প্রদান করা হলো। সাঁওতাল গ্রামগুলির আর্থ-সামাজিক অবস্থা খুবই করুণ। আমরা যে তিনটি গ্রামে এই কর্মসূচী নিয়ে গিয়েছিলাম সে তিনটি গ্রামে মাত্র ১টি নলকূপ আছে! এবং কোন প্রকার স্যানিটারী ল্যাটট্রিন নেই! আমরা ঠিক করলাম পরবর্তীতে অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমরা এই গ্রামগুলির বিভিন্ন পয়েন্টে স্যানিটারী ল্যাটট্রিন এর ব্যাবস্থা আমাদের ক্লাব হতে করে দেবো। এরপর শুরু হলো শীতবস্ত্র (কম্বল) বিরতণ। আমি অবাক হয়ে গেলাম যে গ্রামের মানুষজন অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাড়িয়ে গেল কোন প্রকার শব্দ নেই! এতো মানুষ, এরকম একটি নিভৃত পল্লীগ্রামের অধিবাসী কিন্তু আচার-আচরণে এরা তথাকথিত সভ্যসমাজের অনেককেও হার মানিয়ে দিলো! শীতবস্ত্র বিতরণ শেষে আমরা তাদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে গ্রাম থেকে বেরিয়ে মাটির রাস্তায় পৌঁছলাম, আমি একটু দ্রুত হেটে আগেই চলে এসেছিলাম। গাড়ির কাছে পৌঁছানোমাত্র ছোটছোট ৫জন গ্রাম্য শিশু আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে হঠাৎ বলে উঠলো... “ভালো করে যাওয়ো...” আমি ভালোলাগা এমনই পর্যায়ে উন্নীত হলো যে আমি কিছুই বলতে পারলাম না, শুধু তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে... সে অনুভূতি প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি সত্যিই...

ফেরার পথে শুধু একটি চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল আমাদের সমাজে অনেক মানুষ/কোটিপতি আছে। যারা হয়তো জন্মাবার পর থেকে মারা যাবার মধ্যবর্তী সময়ে জানতেই পারেন না যে আমাদের দেশে এমনও মানুষ আছে যাদের গ্রামে কোন নলকূপ নেই, নেই কোন স্যানিটারি ল্যাটট্রিন, বিদ্যুৎ বা অন্যান্য আধুনিক সুবিধা তো দূরে থাক। এই চিন্তাটি যে আমার এই প্রথম হলো তা নয়, আমি আগেও রংপুর ও জয়পুরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে আদিবাসী মানুষের সাথে কাজ করেছি ১ বছর। প্রতিবারই ফেরার সময় আমার মন খারাপ থাকতো। আমরা নিজেরা যারা নলকূপের পানি প্রথমে ফুটিয়ে, তারপর ফিল্টারে দিয়ে তা খেয়ে অভ্যস্ত তাদের কাছে এসব হয়তো গল্পই মনে হবে। আমি জানি যে একেবারে হয়তো অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব নয়, কিন্তু সবার সহযোগীতা ও আন্তরিকতার দ্বারা সেটি ধীরে হলেও সম্ভব। মিশ্র অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরলাম বাড়িতে...



2 comments:

  1. স্যার আপনার সাথে ঐ মানুষ জন্য সাহায্য করতে পারলে ভালো লাগত।

    ReplyDelete
  2. I have browsed your blog. I am impressed. Allah bless you and your sincere efforts, Ameen.

    ReplyDelete